নদীর মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব বিরল। এক জীবনে দু’বার সেই কাজটি করতে পারা, সম্ভবত বিরলতম। মনমোহন সিংহ সেই বিরলতম কৃতিত্বের অধিকারী। দু’বারই সেই ভগীরথ হতে পারার সুযোগটি তাঁর কাছে এসেছিল আকস্মিক ভাবে— প্রথম বার, আই জি পটেল যখন নরসিংহ রাও মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হতে নারাজ হলেন; এবং দ্বিতীয় বার, বিজেপির কুৎসিত আক্রমণকে ভোঁতা করতে সনিয়া গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী না-হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মনমোহন সিংহের কৃতিত্ব, ঘটনাচক্রে হাতে আসা সুযোগকে তিনি হেলায় হারাননি। প্রথম বার, ১৯৯১ সালে, তিনি ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে অনিবার্য ভরাডুবি থেকে উদ্ধার করেছিলেন তো বটেই, তাকে স্থাপন করেছিলেন অর্থনীতির বিশ্বমঞ্চে। সে কথা বহু-আলোচিত। যা নিয়ে তুলনায় কম কথা হয়, তা হল, ১৯৯১ সালে দাঁড়িয়ে ‘সমাজের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ’-কে যমুনার জলে ভাসিয়ে উদার অর্থনীতির আবাহন করা কতখানি কঠিন একটি কাজ ছিল। হ্যাঁ, বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার যে তলানিতে ঠেকেছিল, কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ব্যতীত তাকে সামলানো যেত না ঠিকই, কিন্তু দেশের আর্থ-রাজনীতির যে অবস্থানটি থেকে মনমোহন সিংহ সচেতন ভাবে সরে এলেন, সেটি ছিল নেহরু-গান্ধী জমানার উত্তরাধিকার— কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে এক অলঙ্ঘ্য দেবকাঠামো। রাজীব-হত্যার পরে গান্ধী পরিবার সে সময় রাজনীতি থেকে সুদৃঢ় দূরত্ব বজায় রাখছিল, কিন্তু কর্তার ভূতের সঙ্গে লড়াই করার কাজটি কঠিনতর। মনমোহন সিংহ বিনা আস্ফালনে, তাঁর স্বাভাবিক বিনয়ী ভঙ্গিতে এই পর্বত টপকে ছিলেন, ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে নিজের স্কন্ধে স্থাপন করে। প্রায় দু’দশক পরে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির প্রশ্নেও দেখা গিয়েছিল তাঁর সেই নীরব দৃঢ়তা।
১৯৯১-এর মনমোহন জানতেন, আর্থিক উদারীকরণের প্রকল্পটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে, বা তার দৌলতে তুমুল জনরোষ তৈরি হলে তাঁকে বলির পাঁঠা করতে কংগ্রেস নেতৃত্ব দ্বিতীয় বার ভাববে না; অর্থব্যবস্থার লাভ হলে তার কৃতিত্ব পাবেন প্রধানমন্ত্রী ও দল। নিয়তির এমনই পরিহাস যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওকে পরবর্তী কালে কংগ্রেস কার্যত অস্বীকার করল, মনমোহন সিংহ মনোনীত হলেন ইউপিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় সূচনা হল এক নতুন পর্বের— শিক্ষা থেকে খাদ্য, তথ্য থেকে কর্মসংস্থান, রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ পাওনাগুলিকে অধিকার হিসাবে স্বীকার করা হল। এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন— নাগরিক আর সরকার অথবা নেতার বদান্যতার উপরে নির্ভরশীল নন, তাঁরা রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জায়গায় এলেন। বস্তুত, ‘প্রজা’ থেকে ‘নাগরিক’-এ উত্তরণের পথে এটি এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ ধাপ। আজ নরেন্দ্র মোদী-জমানার এক দশক পেরিয়ে যদি ফিরে তাকানো যায়, স্পষ্ট হবে যে, সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক সরকারও নাগরিকের এই সংবিধানসিদ্ধ অধিকারগুলি অস্বীকার করতে পারেনি।
অর্থমন্ত্রী মনমোহন না থাকলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের পক্ষে এই অধিকারভিত্তিক উন্নয়ননীতির পথে হাঁটা সম্ভব হত কি? অর্থব্যবস্থায় বৃদ্ধির হার না-বাড়লে, বণ্টন করার মতো সমৃদ্ধি অর্জন না করতে পারলে বড় জোর যা হত, নেহরুর ভাষায় তা ‘দারিদ্রের পুনর্বণ্টন’। তা হলে কি ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী মনমোহনকেই অধিকতর গুরুত্ব দেবে? একটু ঘুরপথে ভাবা যেতে পারে। আর্থিক উদারীকরণের নীতি থেকে পরবর্তী কালের কোনও সরকারই সরেনি, এমনকি সাঙাততন্ত্রের মহাসাধকরাও নয়। তার কারণ, এই সংস্কার বাজারকে গতিশীল করেছিল। অন্য দিকে, অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের নীতির মূল অভিমুখ ন্যায্য পুনর্বণ্টন ও সর্বজনীনতার দিকে। দ্বিতীয় নীতিটি সচরাচর বাজারের সমর্থন পায় না। সে কথাটি জেনেও সেই নীতির পথে হাঁটতে পারার গুরুত্বই বা কী ভাবে অস্বীকার করা চলে?