দেশের মধ্যে যে রাজ্য সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত, সেই রাজ্যই যদি একের পর এক পণ সংক্রান্ত মৃত্যুর কারণে শিরোনাম হইয়া উঠে, তবে তাহা গভীর আশঙ্কার। কেরলের ঘটনাক্রমে সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। সেই প্রসঙ্গে কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের বক্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। আচার্য হিসাবে তিনি কেরলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ডাকিয়া প্রস্তাব দিয়াছেন, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি এবং ডিগ্রির শংসাপত্র প্রদানের সময় পড়ুয়াদের নিকট হইতে পণ দেওয়া এবং লওয়া হইতে বিরত থাকিবার মুচলেকা গ্রহণ করা হউক। অতঃপর কাহারও বিরুদ্ধে পণ সংক্রান্ত অভিযোগ উঠিলে তাঁহার ডিগ্রিটি বাতিল করা হউক। রাজ্যপালের এই পরামর্শদান যথাযথ কি না, সেই প্রশ্ন থাকিতেছে— প্রয়োজনে তিনি মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার অন্য কোনও সদস্যকে ডাকিয়া পরামর্শটি দিলেই তাহা সমীচীন ও শোভন হইত— কিন্তু, পরামর্শটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রস্তাবটিতে নূতনত্ব আছে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু ভাবনা এক বিষয়, আইনগত প্রয়োগ অন্য। এই ক্ষেত্রে আইনত এমন পদক্ষেপ সম্ভব কি না, তাহা লইয়া বিতর্ক দানা বাঁধিয়াছে। বিতর্ক মূলত ডিগ্রি বাতিলের প্রস্তাবটি লইয়া। ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে যাঁহারা যুক্ত, তাঁহাদের ক্ষেত্রেও শিক্ষাগত ডিগ্রি বাতিল করা হয় না। পণের ক্ষেত্রে কি তাহা সমীচীন হইবে? তবে ইহাও সত্য, দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও পণ সংক্রান্ত নিগ্রহের ঘটনা যে রূপ বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহাতে অন্য পথে ভাবনাচিন্তা করা একান্ত প্রয়োজন। যেমন, কেরলেই ১৯৬১ সালের আইন অনুযায়ী, পণ প্রদান এবং গ্রহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বিবাহে গহনা, নগদ, সম্পত্তি, গাড়ি-সহ নানাবিধ পণ্যের আদানপ্রদানের রীতি প্রচলিত আছে। রাজ্য পুলিশের তথ্য বলিতেছে, গত পাঁচ বৎসরে অন্তত ৬৬টি পণ সংক্রান্ত মৃত্যু এবং ১৫,০০০-এর অধিক নিগ্রহের ঘটনা নথিভুক্ত হইয়াছে।
পণপ্রথা যে হেতু এক সামাজিক অপরাধ, সমাজকেও সেই সংশোধনের দায় লইতে হইবে বইকি। অপরাধ প্রমাণিত হইলে অপরাধীকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা যাইতে পারে কি না, ভাবা প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তিও কার্যকর প্রমাণিত হইতে পারে। এক সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং ঠেকাইতে আইন করা হইয়াছিল, দোষী প্রমাণিত হইলে সে ভারতের কোনও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাইবে না। নিরন্তর প্রচার এবং কঠোর আইনের যুগপৎ মিশ্রণে র্যাগিংয়ের ঘটনা পূর্বের তুলনায় হ্রাস পাইয়াছে। পণের ক্ষেত্রেও অপরাধী কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকিলে তাহাকে বহিষ্কারের কথা ভাবা যাইতে পারে। এবং প্রয়োজন সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধির। রাজ্যপালের প্রস্তাবটিতে অসঙ্গতি থাকিলেও উদ্দেশ্যটি সাধুবাদযোগ্য। পণপ্রথার ন্যায় ঘৃণ্য অপরাধকে মুছিতেই হইবে, এবং সেই নৈতিক শিক্ষার সূচনাটি শিক্ষালয় হইতেই করিতে হইবে। নিরন্তর প্রচার, পাঠ্যক্রমে ইহার অন্তর্ভুক্তি, পণপ্রথা সংক্রান্ত আইন ও তাহার প্রয়োগের বিষয়টি শিক্ষার্থী এবং তাহাদের মাধ্যমে অভিভাবকদের নিকট তুলিয়া ধরিতে হইবে। অন্যথায়, ইহা নানা কোণে, নানা ভাঁজে, নানা রূপে থাকিয়া যাইবে। এবং প্রতি বৎসর অসংখ্য জীবন এই প্রথার নামে ঝরিয়া যাইবে।