প্রতীকী ছবি।
চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের আর ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ নহে, ‘চরক শপথ’ লইবার প্রস্তাব করিয়াছে জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন। এখনও পর্যন্ত ইহা প্রস্তাব, কিন্তু চাপাইয়া দিতে কত ক্ষণ— আশঙ্কায় প্রতিবাদ জানাইয়াছে চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। স্মরণাতীত কাল ধরিয়া গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার জনক বলিয়া বিশ্রুত, তাঁহার নামাঙ্কিত নির্দেশাবলি পালনের সঙ্কল্প করিয়াই বিশ্বময় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসাকার্যে রত হন। আবিশ্ব অনুসৃত সেই রীতি হইতে বিযুক্ত হইয়া, ভারতীয় ডাক্তারি পড়ুয়াদের চরক-নামাঙ্কিত শপথবাক্য পাঠের প্রস্তাবে এক আদ্যন্ত দেশীয় প্রথাকে উৎসাহদানের প্রবণতা প্রচ্ছন্ন। জ্ঞানের জগৎ উন্মুক্ত, বিশেষত চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিগন্ত সতত ক্রমপ্রসার্যমাণ, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল বা প্রজন্মের মধ্যেই তাহার বহু পরিবর্তন, গ্রহণ-বর্জন দৃষ্ট হয়। উহাই তাহার চরিত্র, ইহাতেই তাহার আধুনিকতা। এই বৈশ্বিক গতিশীলতার চর্চাকে রুদ্ধ করিয়া, হঠাৎ এক অতিজাতীয়তার স্ফুরণে দেশীয় ইতিহাস খুঁড়িয়া এক প্রত্নচরিত্রকে তুলিয়া আনা অত্যন্ত আপত্তিকর।
কেহ বলিতেছেন, ‘চরক শপথ’-এ তো ভারতীয় ঋষি সেই ‘হিপোক্রেটিক ওথ’-এর অন্তর্বস্তু ‘মেডিক্যাল এথিক্স’-এর কথাই বলিতেছেন, তাহা হইলে উহা উচ্চারণে আপত্তির কারণ কী? কারণ, মহর্ষি চরক আয়ুর্বেদের ন্যায় একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতিরই উদ্গাতা, সারা বিশ্বে যাহার গ্রহণযোগ্যতা সমান নহে। চরক শপথের বিরুদ্ধে চিকিৎসকেরা স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, কোভিডের তিন-তিনটি তরঙ্গ ভারতীয় ও বিশ্বের চিকিৎসকরা সামলাইয়াছেন ‘আধুনিকতম’ চিকিৎসাবিজ্ঞান দ্বারা, আয়ুর্বেদ দিয়া নহে। ঠিক যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসিতেছে, তখনই ভবিষ্যতের চিকিৎসকদের সামনে চরক শপথের প্রস্তাব সেই আধুনিকতার চরম অবমাননা, প্রাচীনপন্থা আঁকড়াইয়া ধরার অপদৃষ্টান্ত। এই প্রবণতা নূতন নহে, কিছু কাল আগেই ডাক্তারির ছাত্রদের পাঠ্যক্রমে ‘যোগ’-এর বাধ্যবাধকতা, আয়ুর্বেদের ছাত্রদের পাঠ্যক্রমে অ্যালোপ্যাথির পাঠ-অনুশীলনের অনুমতি— কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এই ‘মিক্সোপ্যাথি’র প্রচার-প্রসারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়াইয়াছিল। কাজ যে হয় নাই, চরক শপথেই প্রমাণ।
অর্থাৎ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের নৈতিক উত্তরণ বা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সশ্রদ্ধ রক্ষণ নহে, চিকিৎসাবিদ্যাকে ভারতীয় দেশজ ঐতিহ্যের মোড়কে পুরিয়া পরিবেশনের মাধ্যমে জনমানসে দেশীয়তার ধুয়া তোলাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং তাহার চালিকাশক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের আসল উদ্দেশ্য। ইহা আসলে ঘোঁট পাকাইবার রাজনীতি, ধূসর প্রাচীনতাকে যাহা সস্তা জাতীয়তাবাদের পরত দিয়া হইচই বাধাইতে চাহে। ছকটি পরিচিত: কেহ প্রতিবাদ করিলে তাঁহাকে ভারতবিরোধী, ঐতিহ্যবিমুখ বলিয়া দাগাইতে ও রাজনৈতিক ফসল তুলিতে সুবিধা। তবে দেশ ছাপাইয়া বিশ্বেও একটি ভাবমূর্তির ব্যাপার থাকে। চরক শপথের মধ্য দিয়া বিশ্বের কাছে এই ইঙ্গিত গেল, ভারত সম্মুখে নহে, পশ্চাতের দিকে হাঁটিবার তোড়জোড় করিতেছে। একুশ শতকে অগ্রবর্তিতা নহে, পশ্চাৎগামিতাতেই তাহার বিশ্বাস। আনুষ্ঠানিক শপথ করিয়া বিপথে যাইবার কীর্তিস্থাপন, কম কথা নহে।