গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে মারীচ সংবাদ নাটকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে নিয়ে রচিত এক কৌতুকগীতি জনপ্রিয় হয়। ‘সিয়া’ সকলের সব খবর রাখে, এমন একটি ধারণা সেই যুগে সুপ্রচলিত ছিল। সেই ধারণাকে মন্থন করেই উঠে এসেছিল ‘বন থেকে বেরোলো টিয়া’ গানটি। সে-গান শ্রোতাদের ডেকে বলত, ‘নুন খাও কি ঝাল খাও কি টক-মিষ্টি খাও’, ‘নিশুত রাতে প্রিয়ার সাথে কোন কথাটি কও’ কিংবা ‘ঘুমের মাঝে স্বপ্নরাজ্যেকোথায় তুমি রও’— সিয়া সব জানে। শ্রোতারা পুলকিত হতেন। তার পরে অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে। সিআইএ-র সেই রহস্য-রোমাঞ্চে থরথর ভাবমূর্তির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, সিয়া নামটিও এখন অস্তগামী প্রজন্মের বিপ্লবস্পন্দিত বুকে নেহাতই ক্ষীণ স্মৃতি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের নিভৃত খবর বেহাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কি কিছুমাত্র কমেছে? একেবারেই না। বরং ঠিক উল্টো— ব্যক্তিগত জীবনের নিভৃতি জিনিসটাই দেখতে দেখতে প্রায় নেই হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে রাত অবধি কে কখন কী করে, কার সঙ্গে কী কথা বলে, কী দেখে কী শোনে কী পড়ে, এমনকি একা একা কী ভাবে, তার কত কিছুই যে হাতের মোবাইল বা ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ মারফত দুনিয়ার হাটে ছড়িয়ে পড়ছে! ‘ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট’ কথাটাই এখন অকিঞ্চিৎকর, এই ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত আপাদমস্তক— হৃদয় এবং মস্তিষ্ক সমেত— ছাপ না রেখে বেঁচে থাকাই দুঃসাধ্য। ব্যক্তিপরিসর এখন জগৎপারাবারে পরিণত।
প্রাইভেসি বা নিভৃতির এই বিলয় মানুষের জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, সে বিষয়ে সম্প্রতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ডিজিটাল দুনিয়ার অন্যতম অগ্রণী উদ্যোগী, অ্যাপল সংস্থার কর্ণধার টিম কুক। তাঁর মতে, সারাক্ষণ নজরদারির মধ্যে থাকতে থাকতে, সেই নজরদারি বা তার আশঙ্কা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে তার চিন্তার ধাঁচ, স্বাভাবিক খোলামেলা আচরণ কমছে, এমনকি কমছে চিন্তা করার অভ্যাসটাই। তিনি উদ্বেগের সুরে বলেছেন, “যে পৃথিবীতে আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে চলি, সেখানে সমাজেরও বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে।” কথাটা নতুন নয় নিশ্চয়ই। সর্বদ্রষ্টা নজরদার বসানোর ফলে কী ভাবে কারাগারের বন্দিদের আচরণ পাল্টে যায়, সুদূর অষ্টাদশ শতাব্দীতে জেরেমি বেন্থাম তার প্রকৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। এমনকি, নজরদার বাস্তবে না-থাকলেও চলবে, কেবল বন্দিরা ভাবলেই হল যে সে আছে। বলা বাহুল্য, এ কেবল কারাগারে নয়, সমাজজীবনেও সত্য। আজকের ডিজিটাল নজরদারির ব্যাপ্তি ও ক্ষমতা যেখানে পৌঁছেছে, বেন্থামের ‘প্যানঅপ্টিকন’ তার কাছে শিশু। এবং এ ক্ষেত্রেও বাস্তবিক নজরদারি কতটা হচ্ছে, ব্যক্তির আচরণের উপরে তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে নজরদারি সম্পর্কে তার ধারণা। মানুষের এই ধারণা উত্তরোত্তর জোরদার হচ্ছে যে, তার জীবনের কিছুই আর গোপন নেই। এ বড় স্বস্তির সময় নয়।
এই অস্বস্তি এবং উদ্বেগের জন্য ব্যক্তিমানুষের অভ্যাসকে দায়ী করা সহজ। দায়িত্ব বাস্তবিকই আছে। কে নিজেকে কতখানি অবারিত করে দেবেন, নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ এবং নিজের চিন্তাভাবনার প্রতিটি অণু-পরমাণুকে সেই দুনিয়ার মঞ্চে তুলে ধরবেন কি না, সে বিবেচনার ব্যক্তিগত দায় অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই দুনিয়া নিছক বহু ব্যক্তির অবাধ বিচরণের পরিসর নয়, ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণ সেখানে অত্যন্ত প্রবল। এক দিকে বাণিজ্যিক ক্ষমতা, অন্য দিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। ডিজিটাল পরিষেবার বাজারে অল্প কয়েকটি অতিকায় সংস্থার অকল্পনীয় প্রতিপত্তি সমস্যাকে এক নতুন এবং ভয়াবহ মাত্রা দিয়েছে, কারণ মানুষের প্রতিটি আচরণই এই সংস্থাগুলির কাছে ব্যবসার কাঁচামাল, ওই আচরণের ভিত্তিতেই ব্যক্তিকে তারা বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার বিক্রেতার কাছে পরিবেশন করে, এই বাজারে ব্যক্তিমাত্রেই নিছক সম্ভাব্য ক্রেতা। স্পষ্টতই, এটা ব্যক্তির স্বক্ষমতার পক্ষে বিপজ্জনক। বিপদের অন্য মাত্রাটি রাষ্ট্রের অবদান। ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকরা কী ভাবে ব্যক্তিগত তথ্য জেনে নিতে পারে এবং কী ভাবে নিজেদের স্বার্থে সেই তথ্য ব্যবহার ও অপব্যবহার করতে পারে, গত কয়েক বছরে তার বহু নজির তৈরি হয়েছে। টিম কুক এই গভীরতর বাস্তবের মধ্যে যাননি, তাঁর কাছে সেই প্রত্যাশাও নেই। দর্শক-শ্রোতারা আপাতত ডিজিটাল দুনিয়ার নতুন মারীচ সংবাদের অপেক্ষায়।