প্রতীকী চিত্র।
বহু ছাত্রছাত্রীই বড় শহরের বাসিন্দা নহে। উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ তাহাদের নাগালের বাহিরে। এই কারণে কলিকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট তাহাদের ক্যাম্পাস আংশিক ভাবে খুলিয়া দিল। মোট ছাত্রসংখ্যার অনধিক পঁচিশ শতাংশ ক্যাম্পাসে থাকিতে পারিবে, পরিকাঠামো ব্যবহার করিতে পারিবে। ঘটনা হইল, আইআইএম-এর ন্যায় অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাহারা পড়িতে আসে, তাহাদের অসুবিধা অগ্রাহ্য করা মুশকিল— তাঁহাদের কণ্ঠস্বর বহু দূর অবধি পৌঁছাইতে পারে। যে ছেলেমেয়েরা ক্ষীণকণ্ঠ, যাহাদের পরিবার-পরিজন সামাজিক প্রতিপত্তিহীন, তাহাদের অবজ্ঞা করা তুলনায় সহজ। গত দেড় বৎসর যাবৎ দেশের সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই অবজ্ঞাই করিতেছে। অধিকতর অবজ্ঞা করিতেছে সরকার। অতিমারি সামলাইবার জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ করিয়া দিলেই যেন সরকারের দায় মিটিয়া যায়— এই সিদ্ধান্তের ফলে বহু ছেলেমেয়ের শিক্ষার সুযোগটিই সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় কি না, তাহা ভাবা যেন সরকারের দায়িত্ব নহে।
কোন পথে ভাবা যাইতে পারে, কলিকাতার আইআইএম তাহা দেখাইয়া দিল। প্রশ্ন উঠিবে, আইআইএম-এর যেমন ক্যাম্পাস রহিয়াছে, দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েরই তাহা নাই। ফলে, ছাত্রছাত্রীদের আনিলেও তাহারা থাকিবে কোথায়? আপত্তিটি উড়াইয়া দিবার নহে। কিন্তু, আংশিক ভাবে ক্যাম্পাস খুলিয়া দেওয়া একটি সমাধানসূত্র— একমাত্র নহে। প্রশ্ন হইল, ছাত্রছাত্রীদের কোথায় অসুবিধা হইতেছে, তাহা চিহ্নিত করিয়া নীতিনির্ধারকরা সেই অসুবিধা দূর করিতে তৎপর কি না। যদি উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট থাকে, তবে বিকল্প পথ খুঁজিয়া পাওয়া অসম্ভব নহে। যেমন, প্রতিটি মহকুমা সদরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘ইন্টারনেট হাব’ তৈরি করা যাইতে পারে। এমন একটি পরিসর, ছাত্রছাত্রীরা যেখানে বিনামূল্যে ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করিতে পারিবে। স্থানীয় স্কুল, পাঠাগার বা অন্য কোনও প্রেক্ষাগৃহকে এই হাবে পরিণত করা যায়। সামাজিক দূরত্ববিধি বজায় রাখিয়াই তাহা ব্যবহারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। স্থানীয় স্তরে শিক্ষকদের পাঠদানের ভিডিয়ো প্রদর্শনের ব্যবস্থা; ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট দল গড়িয়া প্রতিটি দলের জন্য প্রাইভেট টিউশনের ন্যায় ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া— সরকারি ভাবনা বহু পথেই প্রবাহিত হইতে পারে। তাহার জন্য নেতাদের ভাবনার প্রসারতা প্রয়োজন— আরও বেশি প্রয়োজন ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা দূর করিবার প্রকৃত সদিচ্ছা।
কোনও চেষ্টাই হয় নাই, তাহা বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছাত্রছাত্রীদের ট্যাবলেট দিয়াছে; ইন্টারনেট সংযোগে গতি আনিবার চেষ্টাও করিয়াছে। শিক্ষকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়া পড়া বুঝাইয়া আসিয়াছেন, খোলামেলা জায়গায় ছেলেমেয়েদের আনিয়া ক্লাস বসাইয়াছেন। বহু ক্ষেত্রে অবস্থাপন্ন ছাত্রছাত্রীরা চাঁদা তুলিয়া আর্থিক ভাবে পিছাইয়া থাকা সহপাঠীদের জন্য ডেটা প্যাক কিনিয়া দিয়াছে। সবই সত্য— কিন্তু এ কথাও সত্য যে, এই প্রচেষ্টাগুলি এখনও বিচ্ছিন্ন। তাহাকে সংহত রূপ প্রদানের উপায় একটিই— সরকারকে নীতিগত ভাবে স্বীকার করিতে হইবে যে, কোনও কারণেই ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার খর্ব করা যাইবে না; তাহার জন্য যাহা করিতে হয়, সরকার করিবে।