Laughter Weapon

হাস্যাস্ত্র

এত যে ক্ষমতা হাসির, সহজে তা বোঝা যায় না হয়তো, কিন্তু ঘটনা হল— হাসি, রঙ্গ, রসিকতা, এ সবই ক্ষমতার চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা রাখে, এবং রসের আড়ালে তীব্র প্রতিবাদ ডুবিয়ে রাখতে পারে। ছোঁয়াচে রোগের মতো দ্রুত দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫ ০৬:৪৩
Share:

হাসি অতি বিষম বস্তু। রবীন্দ্রনাথের গান যদিও বলেছিল ‘যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন’, রবীন্দ্রনাটকের চরিত্রের মুখে কিন্তু জোরালো ক্ষোভ রণিত হয়ে উঠেছিল, ‘মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব’। হাসিকে, হাসির অধিকারকে রক্ষা করার জন্য দরকারে তাই রাজসভা ত্যাগ করে পথে এসে দাঁড়ানোও ভাল। এত যে ক্ষমতা হাসির, সহজে তা বোঝা যায় না হয়তো, কিন্তু ঘটনা হল— হাসি, রঙ্গ, রসিকতা, এ সবই ক্ষমতার চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা রাখে, এবং রসের আড়ালে তীব্র প্রতিবাদ ডুবিয়ে রাখতে পারে। ছোঁয়াচে রোগের মতো দ্রুত দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। সুতরাং দাম্ভিক পরাক্রমী ক্ষমতা-উপাসকের প্রথম কাজই হল, নিজের চার ধার থেকে হাসির কাঁটা উৎপাটন করা। রঙ্গরঙিন কল্পনার জোগানদারদের হয় দেশছাড়া করা, নয় ভয়ে কাঁটা করে রাখা, নয় সর্বক্ষণের প্রহরায় রাখা। উপরের ওই কথাটি বিদূষক চরিত্রের মুখে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, লিপিকা-র অন্তর্ভুক্ত ‘বিদূষক’ নামের ছোট নাটিকাটিতে। কর্ণাট বিজয় করে, ধ্বংসযজ্ঞ সমাধা করে, কাঞ্চীর রাজা যখন ফিরে আসছেন, তখন পথে দেখলেন এক গ্রামে কিছু বালক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করছে, এবং সেই খেলায় তারা কাঞ্চীকেই পরাজিত পক্ষ বানিয়েছে, কর্ণাটকে বিজয়ীর মুকুট দিয়ে! দেখেই রাজার রোষ তুঙ্গে চড়ল, তিনি আদেশ দিলেন শাস্তির ব্যবস্থা করতে। লাঠিসোঁটাবল্লম নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন সেনাপতি। সবার দফা একেবারে রফা করে দিলেন। রাজার দরবারে ফিরে হৃষ্টমুখে জানালেন, সব ব্যবস্থা পাকা, শৃগালকুকুর ছাড়া আর কারও গলায় এ বার থেকে আওয়াজ শোনা যাবে না এ রাজ্যে! এই শুনেই বিদূষক তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ভাষণে বললেন, ‘আমি মারতেও পারিনে, কাটতেও পারিনে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব।’ অতঃপর তাঁর নিষ্ক্রমণ।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ সত্যদ্রষ্টা ছিলেন কি না জানা নেই, কিন্তু নিপুণ ইতিহাস-দ্রষ্টা ছিলেন। ইতিহাসের মধ্যে ধরা থাকে মানুষের চিরকালীন আখ্যান, বার বার এসে বার বার যা ফিরে যায়, আবার আসে। ফলে পুঁথিতে পড়া সাহিত্য কখনও কখনও একেবারে ঘটমান বর্তমান হয়ে যায়। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতাপ মাত্রা ছাড়ালে প্রতিবাদ আড়ালে আবডালে হাসির আড়ালে এমন ভাবেই ভেসে ওঠে। ছড়ি হাতে তাদের দফারফা করতে ছুটেন আজ্ঞাপ্রাপ্ত সেনাপতিরা। অসহায় ও অক্ষমের নাগালের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন হাস্যপরিহাসের অস্ত্র, কী ভাবে তা কেড়ে নেওয়া যায়, সেই ভেবে রাষ্ট্রশক্তির ঘুম ছুটে যায়। এক দিক দিয়ে এর মধ্যে হাসিরই জয়। কেননা যখনই শাসক এই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, স্পষ্ট বোঝা যায় যে হাসি দিয়ে শাসককে যথেষ্ট মাত্রায় ত্রস্ত করা গিয়েছে বলেই প্রত্যাঘাত আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। তবে কালে-কালে হাসির ধরন পাল্টায়। এক রকম হাসি আছে, চটুল কিন্তু অগভীর। শাসকও জানেন সঙ্কটের ভয় সেখানে কম। কিন্তু আর এক রকমের হাসি আছে, উপর থেকে হালকা হলেও ভিতরে যার মারটা বেশ ভারী, তীব্র, তীক্ষ্ণ। বিদ্রুপের সেই হুল তার বিষ চারিয়ে দিতে পারে অনেক ভিতরে, গভীরে। শাসক জানে, সেই হাসিই ভয়ের। শুনতে বিনোদন হলেও আসলে সেটা রাজনীতি— ও দেশের স্যাটায়ার ঐতিহ্য থেকে এ দেশের গম্ভীরা ঐতিহ্য, সবই তাই। স্বৈরশাসক মাত্রেই জানেন, ওই হাসিতে ভয়ের কারণ বিস্তর, কেননা ওই হাসিতে আছে তার অধিকারকে প্রশ্ন করার, হনন করার দুঃসাহস।

বর্তমান সময়ে সমাজমাধ্যম হাসির এই প্রতাপকে বহুশত গুণ বাড়িয়ে ও ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। হাত থেকে হাতে, মুখ থেকে মুখে এখন মুহূর্তমধ্যে এগিয়ে যেতে পারে যে কোনও পরিহাস, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ। অলীক কুনাট্যরঙ্গে মানুষকে মজাতে এখন কোনও আয়াসই লাগে না, তেমন প্রয়াসও নয়। এক ক্লিকেই বাজি মাত। সুতরাং, শাসকের দমনও তাল মিলিয়ে ভয়ানকতর হয়ে উঠছে ক্রমশ। দেশে দেশে সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিস্টদের পাশাপাশি ‘টক শো হোস্ট’-রাও ঘোর সঙ্কটে। এক দিকে রাজনীতির মান নামছে নীচের দিকে, অন্য দিকে তার প্রতাপ বাড়ছে উপরে নীচে সামনে পাশে— রাজনীতির সেই রাগ ঝরে পড়ছে রঙ্গকর্মীদের উপর। এ যেন বাস্তবের সঙ্গে অর্ধবাস্তবের যুদ্ধ, নীরস কঠিনের সঙ্গে সরস সহজের কালান্তক ঠোকাঠুকি। শেষ জয় কার? ছোট করে বলে দিয়েছেন জার্মান-আমেরিকান দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ হানা আরেন্ট: “দ্য গ্রেটেস্ট এনিমি অব অথরিটি ইজ় কনটেমট, অ্যান্ড দ্য শিয়োরেস্ট ওয়ে টু আন্ডারমাইন ইট ইজ় লাফটার।”

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement