কেন্দ্রীয় শাসকরা হয়তো অচিরেই দাবি করবেন— দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তুলতে তাঁরা যে কতখানি দায়বদ্ধ, স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে তার এক বিরাট প্রমাণ তাঁরা ইতিমধ্যেই দাখিল করেছেন। কী প্রমাণ? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি নির্দেশে একাধিক রাজ্যে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন বা আফস্পার আওতায় চিহ্নিত ‘উপদ্রুত এলাকা’র পরিধি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে— প্রধানত অসমে, তার সঙ্গে নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে কিছু জেলা অথবা থানা এলাকাকে ওই তকমা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মোদ্দা কথা— আফস্পার ফাঁস কিছুটা আলগা করা হয়েছে। অতএব, প্রতিষ্ঠিত হল, ভারতীয় গণতন্ত্র সুরক্ষিত। ঠিক? না, ভুল। উপদ্রুত এলাকার আয়তন কমছে, সেটা অবশ্যই ভাল। কিন্তু আইনের নাগাল কমানোটা নিতান্তই গৌণ ব্যাপার, প্রয়োজন এই আইন রদ করার। আফস্পা এমন একটি আইন, যার অস্তিত্বই সরাসরি গণতন্ত্রের বিরোধী। কথাটা বহু বছর ধরে অসংখ্য বার বলা হয়েছে। মানবাধিকার আন্দোলনের শরিক বা গণতন্ত্রের স্বার্থে সংগ্রামরত বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সংগঠন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন গত কয়েক দশক ধরে। সে-সব নাহয় ‘আরবান নকশাল’দের ব্যাপারস্যাপার, দেশের সর্বোচ্চ আদালত একাধিক বার এই আইন প্রয়োগের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সেই উদ্বেগ আকাশ থেকে পড়েনি, বিভিন্ন রাজ্যে আফস্পার প্রদত্ত কার্যত নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্মম ও মারাত্মক আচরণের ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে বারংবার। মণিপুরে এমনই এক তাণ্ডবের পরে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে একটি কমিটি নিয়োগ করে, সেই কমিটি সুপারিশ করে— চিহ্নিত এলাকায় আইন জারি থাকবে কি না, ছ’মাস অন্তর তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ‘উপদ্রুত এলাকা’য় সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত হওয়া চাই, আফস্পা যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র হতে পারে না। এ-সব সদুপদেশ কতটুকু কার্যকর হয়েছে, মহামান্য বিচারপতিরাও নিশ্চয়ই তা জানেন। ‘পর্যালোচনা’র নামে বাঁধা গতে ছ’মাস অন্তর আফস্পার মেয়াদ বাড়িয়ে যাওয়ার রীতিও পরিচিত।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই, কিছু এলাকায়— ছ’মাসের জন্য— এই আইন প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আহ্লাদিত হওয়া মুশকিল। এমনকি, আফস্পার অন্যতম প্রধান মৃগয়াভূমি কাশ্মীরেও যদি অমিত শাহের মন্ত্রকটির এমন ‘গণতান্ত্রিক’ আশীর্বাদ বর্ষিত হয়, তাতেও সেখানকার সামগ্রিক চিত্র পাল্টাবে না। স্বাধীনতার জয়ন্তী উদ্যাপনে শাসকরা যদি সত্যই আন্তরিক হন, তবে তাঁদের কাজ অবিলম্বে এই আইনকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা। ১৯৫৮ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলন দমনের স্বার্থে এই আইন চালু করে প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং তাঁর সরকার অন্যায় করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশেষত ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন দমন করার জন্য যে স্বৈরতান্ত্রিক আইন জারি করেছিল, স্বাধীন ভারতে তার আদর্শে বিধি রচনার নৈতিক অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মতোই, এ ক্ষেত্রেও স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নায়করা ঔপনিবেশিক স্বৈরতন্ত্রের অস্ত্রগুলিকে ক্ষমতার স্বার্থে কাজে লাগাতে পিছপা হননি। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’, ‘সন্ত্রাস’, ‘জাতীয় নিরাপত্তার বিপদ’ ইত্যাদি অজুহাতে অপবিধানের প্রয়োগ চলে আসছে, জারি হচ্ছে নতুন নতুন চণ্ডনীতি। বর্তমান শাসকরা আফস্পার প্রত্যাহারে উদ্যোগী হবেন, এমন আশা বাতুলেও করবে না। অতএব, এই সীমিত এবং সাময়িক বদান্যতাতেই নিরুপায় দেশবাসী কৃতার্থ বোধ করতে পারেন।