সে কালে গ্রামেগঞ্জে কারও মৃত্যু হলে স্বজনবান্ধব মিলে কাছের শ্মশানে দাহকাজ সেরে আসতেন, কেউ ডেথ সার্টিফিকেট চাইত না, কোনও কাগজপত্রের বালাই ছিল না। এখন আর সে দিন নেই, জন্মের মতোই মৃত্যুর খতিয়ানেও সরকারি সিলমোহর চাই। সমাজবিজ্ঞানীরা এই নিয়ে কত গভীর তত্ত্ব রচনা করে দেখিয়েছেন, ‘পপুলেশন’কে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে এনে কেমন ভাবে শাসনের নতুন তরিকা রচনা করা হয়েছে, ‘বায়োপলিটিক্স’-এর নির্মাণে তার কী ভূমিকা, ইত্যাদি ইত্যাদি। নদিয়ার হাঁসখালির চতুর্দশী কন্যাটির জন্য অবশ্য সে-সব কিছুরই দরকার হল না। তার দেহটি রাতারাতি গ্রামের শ্মশানে গিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হল, পুড়ল মেয়ে, উড়ল ছাই, ব্যস। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিতে এমন ঘটনা সম্ভব? অবশ্যই। কেবল সম্ভব নয়, এ জিনিস আকছার ঘটছে। নদিয়ার ওই শ্মশানটিতেই এমন কত দেহ যে ভস্মীভূত হয়েছে, তার কোনও হিসাব সরকারের খাতায় নেই। ওখানে তেমন হিসাব রাখার কোনও ব্যবস্থাই নেই। ওই শ্মশানে নাকি এমনটাই দস্তুর, কারও দাহকর্মের প্রমাণ দরকার হলে কাছাকাছি এলাকার অন্য শ্মশান থেকে সে জিনিস সংগ্রহ করতে হয়। এবং, এই ঘটনাটির সূত্রেই সংবাদমাধ্যমে কিঞ্চিৎ নাড়াচাড়া হয়েছে, নানা অঞ্চলে এমন রকমারি ‘বেওয়ারিশ’ শ্মশানের খোঁজ মিলেছে। পরিচিতি এবং প্রমাণ ছাড়াই কত দেহকে যে এমন ভাবে গোপনে বা আড়ালে ভস্ম করে দেওয়া হয়, তার কিছু আঁচ উদাসীন নাগরিক বলয়ে গুনগুন করছে। স্থানীয় সমাজে খোঁজ অবশ্য ছিলই, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মানুষজন অম্লানবদনে জানিয়েছেন: এ তো কবে থেকেই চলে আসছে!
কিন্তু কী করে চলে আসছে? সরকার কী করছিল? স্বাধীন ভারতের প্রথম পর্বে সম্পূর্ণ অরাজকতার কোনও এক ঘটনায় চমৎকৃত সহনাগরিকের মুখে ঠিক এই প্রশ্ন শুনে এক প্রবীণ বঙ্গবাসী হাত উল্টে বলেছিলেন: এ দেশে সরকার এখনও জন্মায়নি। আজ আর সে-কথা বলার উপায় নেই, স্বাধীন ভারতের বয়স পঁচাত্তর পার হতে চলেছে, পশ্চিমবঙ্গ তার সমবয়সি। সরকারি ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, তার আয়োজন ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে সর্বত্রগামী হয়েছে, সেই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, সচরাচর তাকে গ্রাস করে নিয়ে দলীয় রাজনীতির শাখাপ্রশাখা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি গৃহকোণে, দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু, সুগঠিত, সুবিন্যস্ত আইনের শাসন? সে বস্তু অনেক কাল যাবৎ দুর্লভ হয়েছে, বর্তমান জমানার এক দশক কাটিয়ে এখন কার্যত বিরল।
এই অশাসনের একটা দিক সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। ঠিক ঠিক জায়গায় যদি ফুল বেলপাতা এবং অন্যান্য উপচার জমা দেওয়া হয়, তা হলে নিয়মকানুনকে অবলীলাক্রমে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যা খুশি করা যায়, প্রতি দিন তেমন যথেচ্ছাচারের অজস্র নজির মিলছে, আদালত অবধি আর তার ক’টার খবর পৌঁছয়? কিন্তু অনেক অনাচারের জন্যই প্রত্যক্ষ দুর্নীতিরও কোনও প্রয়োজন হয় না। মানুষ অনাচারকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেন, প্রশাসক বা জনপ্রতিনিধিরাও সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন, বেকায়দায় পড়লে এ ওর দিকে দায় ঠেলে দেন, একান্ত কোণঠাসা হলে বলেন, “ব্যাপারটা বিশদ ভাবে জানা নেই, খোঁজ নিয়ে দেখছি, যা করার করছি।” নদিয়ার ‘বেআইনি’ শ্মশানটির ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পুলিশ প্রশাসন পঞ্চায়েত ইত্যাদির আধিকারিকরা ঠিক এই রাস্তাই নিয়েছেন। তাঁদের জবাবগুলোই বলে দেয়, পশ্চিমবঙ্গ এই ভাবেই চলছে এবং চলবে। বেশি প্রশ্ন তুললে নিশ্চয়ই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বা কর্ত্রীরা মুখঝামটা দিয়ে বলবেন: যান যান, এটা ইউপি নয়, এখানে মৃতদেহের সারি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় না। তা-ও কি আর এখানে ওখানে হচ্ছে না? চিত্রগুপ্ত বলতে পারবেন।