—প্রতীকী চিত্র।
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ভরাডুবি নিয়ে অনেক মহলে আলাপ ও আলোচনার মধ্যে নেতারাও বসলেন আত্মসমীক্ষায়। সুসংবাদ। বরাবরের মতো ‘মানুষকে বোঝাতে না-পারা’ গোত্রের অজুহাত দিয়ে যে এই ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, এমন একটি ইঙ্গিতও যেন মিলল। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের মুখে তার বদলে শোনা গেল আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার কথা। প্রয়োজনীয়তাটি খুব বড় আকারের, সন্দেহ নেই। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে ইন্ডিয়া জোট প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সফল, সেখানে এই রাজ্যে কেন সিপিএম-কংগ্রেস জোট এমন ধরাশায়ী, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার উদ্যোগটি জরুরি বইকি। এই জোট এ বারে মাত্র একটি আসনে জয়ী, যে আসনটি গিয়েছে কংগ্রেসের কাছে। ২০১৬ সালের পর থেকে এই দুই দলের যে রাজনৈতিক অক্ষ, তার ইতিহাসে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেই দুই দলের ভান্ডারে এল সর্বনিম্ন পরিমাণের ভোট— সিপিএমের কাছে ৬ শতাংশ, কংগ্রেসের কাছে ৫ শতাংশ। সাদা নজরেই প্রতীয়মান, ২০২১ সালের প্রচারপর্বে সিপিএমের রাজনীতিতে যে ভুলগুলি ছিল, ২০২৪-এর প্রচারেও তার দীর্ঘ ছায়া। আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে তা থেকে বেরোনো সম্ভব কি না, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকেই এখন তা বুঝতে হবে।
সিপিএমের দলীয় পর্যালোচনায় দু’টি প্রধান প্রশ্ন উঠে এসেছে। প্রথমটি হল, সিপিএম কেন গরিব মানুষের সমর্থন পাচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর স্বভাবতই বহুস্তরীয়। তার প্রথম স্তরে রয়েছে একটি বাস্তব নিরীক্ষণ— পশ্চিমবঙ্গের মতো সমাজে গরিব মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শাসক দলের সঙ্গে থাকলে বহুবিধ সুবিধা পাওয়া সম্ভব, এবং বেশ কিছু অসুবিধা এড়ানো সম্ভব। যে রাজ্যে কর্মসংস্থানের প্রধানতম ক্ষেত্র বহুরূপী সিন্ডিকেট, সেখানে এ কথা আরও সত্যি। পশ্চিমবঙ্গে এ-হেন শাসক-নির্ভরতা আজকের ঘটনা নয়। কিন্তু তার পরেও রাজ্যের গরিব মানুষ যে শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন, এ কথাও সিপিএম হাড়ে হাড়ে জানে বইকি। অতএব, দ্বিতীয় স্তরের উত্তর প্রয়োজন। ঘটনা হল, সিপিএমের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ‘ভদ্রলোক’-প্রীতির পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। দীর্ঘ দিন শাসনক্ষমতায় থাকার ফলে এই শ্রেণির সঙ্গে তাদের যে লেনদেনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, দল ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে সিপিএম সে নির্ভরতা ছাড়তে পারেনি। এই শ্রেণি-অবস্থানটি ঠিক না ভুল, সে প্রশ্নের উত্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট খুঁজবে— কিন্তু, পরিহাসের মতো শোনালেও এ কথা সত্য যে, ‘সর্বহারার পার্টি’-র প্রতি ‘সর্বহারা’-দের আস্থা অতি সীমিত। সেই আস্থা ফিরে পাওয়ার একটি পথ হতে পারত পথে নেমে রাজনীতি। কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়ার মহিমা এমনই যে, ঘামে-ভেজা ধুলোবালির মেঠো রাজনীতি দৃশ্যত তার আকর্ষণ হারিয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, মানুষ কেন সিপিএমকে (বা, বাম-কংগ্রেস জোটকে) যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বিকল্প বলে গণ্য করছেন না। ইতিহাস বলবে, এ রাজ্য চিরকালই দ্বিমেরু রাজনীতিতে বিশ্বাসী— তৃতীয় কোনও শক্তি গুরুত্ব পায় না। সিপিএম যে ভাবে এ রাজ্যের প্রধানতম শক্তি থেকে অকিঞ্চিৎকর তৃতীয় স্থানে (লোকসভা নির্বাচনে কয়েকটি আসন অবশ্য বলছে, চতুর্থ স্থান— সে আসনগুলিতে আইএসএফ-এর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা জোটের চেয়ে বেশি) পৌঁছে গেল, তা হয়তো বিস্ময়কর নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূল বা তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে সিপিএমকে গণ্য করেননি মানুষ। অধিকন্তু, সিপিএমের নিজের প্রধান প্রতিপক্ষ কে, নেতারা এই প্রাথমিক প্রশ্নটির দ্ব্যর্থহীন উত্তর খুঁজে না-পাওয়া অবধি পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে ভরসা হয় না। রাজনৈতিক প্রশ্নের সংখ্যা বিস্তর, গুরুত্বও বিরাট। যথাযথ উত্তর সন্ধানে দীর্ঘমেয়াদে লাভ হতেও পারে।