ফাইল চিত্র।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’— কোভিড-পীড়িতদের সেবায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে দেশ এমন যোদ্ধাদের দেখিতেছে। স্বজনরাও যাঁহাদের ত্যাগ করিয়াছে, তাঁহাদের পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছেন এই স্বেচ্ছাসেবীরা। কেহ ঘরবন্দি রোগীদের খাবার সরবরাহ করিতেছেন, কেহ গণরসুই খুলিয়াছেন, কেহ বা অক্সিজেন সিলিন্ডার, ঔষধ পৌঁছাইয়া দিতেছেন ঘরের দরজায়। ‘সেফ হোম’ খুলিতেছেন। শহর ও গ্রামে কয়েকটি সংগঠন নূতন অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা চালু করিয়াছে। কোভিড-আক্রান্তদের মৃত্যুর পরে তাঁহাদের সৎকারের দায়িত্বও গ্রহণ করিয়াছেন বহু স্বেচ্ছাসেবী। কেবল ওই রোগীরা নহেন, সমস্ত দেশবাসীই ওই সেবানিরত মানুষগুলির জন্য নূতন প্রাণ পাইতেছেন। অতিমারিতে মৃত্যুমিছিল দেখিয়া মানবচিত্ত শিথিল, অবসন্ন হইতে চাহে। ক্লৈব্য দূর করিতে কেবল স্বেচ্ছাসেবীদের অক্লান্ত সেবাকার্যের দিকে তাকাইলেই হয়। ভারতের প্রাচীন ঋষি অমরত্বের সন্ধান পাইয়াছিলেন অবিনাশী আত্মায়। আধুনিক ভারত তাহার খোঁজ পাইয়াছে মানুষে-মানুষে শাশ্বত সম্পর্কে। গত বৎসরও নাগরিক সমাজের এই দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখিয়াছে দেশ। কোভিড অতিমারির আগমন এবং লকডাউনের পর বিপুল সংখ্যক কর্মহীন মানুষকে খাদ্য জোগাইবার দায় রাষ্ট্র কার্যত অস্বীকার করিয়াছিল। সেই সময়ে অগণিত সমাজসেবী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, সংস্কৃতি ও পরিবেশ আন্দোলনের সহিত যুক্ত নানা সংস্থা, এমনকি সহকর্মী, প্রতিবেশী ও বন্ধুরাও পরস্পর মিলিত হইয়া ক্ষুধার সহিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। সেই ধারা এই বৎসরও অপ্রতিহত।
স্বেচ্ছাসেবা সর্বদাই অমূল্য। কিন্তু কোভিড অতিমারিতে তাহার ধারাবাহিকতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তাহা ভেদাভেদের রাজনীতিকে অতিক্রম করিয়া নাগরিক সমাজকে মান্যতা দিয়াছে। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের মেরুকরণ করিবার উদ্দেশ্যে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব আনিবার কম চেষ্টা হয় নাই। ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচিতির দ্বারা নাগরিক হিসাবে তাহার স্থান নির্ণয়, কোন সম্প্রদায় কত ‘বিপন্ন’ তাহার ব্যাখ্যা, সমাজেও বিদ্বেষের আবহ আনিয়াছিল। কোভিডযুদ্ধের স্বেচ্ছা-সেনানীরা ফুৎকারে সেই সকল উড়াইয়া দিলেন। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে তাঁহারা সেবা ও সহায়তা করিতেছেন, এমনকি সৎকার কার্যেও তাঁহাদের ছুতমার্গ নাই। বহু মুসলিম প্রতিবেশী হিন্দুর পরিত্যক্ত দেহকে যথাবিধি দাহ করিতেছেন। অপ্রত্যাশিত কিছু করিবার দাবি তাঁহারা করেন নাই— কর্তব্যের পালন করিয়াছেন শুধু।
‘মানুষের কাজ’ এমনই নীরব, অনাড়ম্বর। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে মানুষের জন্য কাজ করিবার আস্ফালন করিয়াছিলেন নানা দলের বেশ কিছু নেতা। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে তাঁহারা প্রায় সকলেই অদৃশ্য। ভারতীয়ের ধর্ম কী, বাঙালি অস্মিতা কী— নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক স্বার্থে অনেকে এই সব প্রশ্নও তুলিয়াছিলেন। স্বেচ্ছাসেবীর নিঃস্বার্থ সেবায় উত্তর পাইলেন কি? মানবজীবনকে সুরক্ষিত, সম্মানিত করিবার ভাবনাই ধর্মভাবনা, সেই কর্তব্যের পালনই ধর্মপালন। সকল প্রথাগত ধর্ম তাহারই প্রেরণা দেয়, ভারতের সংবিধানে সেই চিন্তাই বিধৃত হইয়াছে। আপন অন্তরেও মানুষ তাহার প্রণোদনা খুঁজিয়া পায়। তাহার শক্তিতেই গণচিতাভস্ম হইতে ফিনিক্স পাখির ন্যায় জাগিয়া উঠিবে ভারত।