হিসাব মিলছে না— জাতীয় হিসাব আর আন্তর্জাতিক হিসাব। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসাব, কোভিড-অতিমারির তিন বছরে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫.২০ লক্ষের কাছাকাছি। অন্য দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সদ্যপ্রকাশিত রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারতে কোভিডে মৃত্যুর ‘প্রকৃত’ সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় হিসাবের প্রায় দশগুণ, সারা বিশ্বে মোট কোভিডজনিত মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটেছে এ দেশে! ভারত স্বাভাবিক ভাবেই এই হিসাব প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা আঙুল তুলেছে এই সংখ্যা নির্ধারণের গাণিতিক মডেল ও তার কার্যপদ্ধতির দিকে: ছোট আয়তনের দেশে যে মডেল কাজ করবে, ভারতের মতো বিপুলায়তন ও বিরাট জনসংখ্যার দেশে তা কার্যকর হবে না, কারণ এখানে একই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ‘কোভিড পজ়িটিভিটি রেট’, কোভিড পরীক্ষার হার ও চরিত্র আলাদা, অন্য বহু উপাদানও।
গণিত-পরিসংখ্যানের মডেল নিয়ে তর্ক, সে আলাদা কথা। আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির একটা ব্যাপার থাকে, কোভিড-অতিমারির গোড়ার দিকে এবং টিকা আসার পরেও ভারত যে অতিমারি মোকাবিলায় ‘বৈশ্বিক নেতৃত্বদান’-এর বড়াই করেছিল, ‘হু’-র রিপোর্টের জেরে সেই গর্ব ধুলায় লুটাল কি না, ভাবনার বিষয়। অবশ্য কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে সেই গৌরবগাথা ভেসেই গিয়েছে— কোভিড পরীক্ষা ও পরিষেবার অব্যবস্থা, হাসপাতালে বেড, অক্সিজেন ও ওষুধের জন্য হাহাকারচিত্র তার সাক্ষী। সরকারের তরফে কোভিডে মৃত্যুর তথ্য ও সংখ্যা ‘চেপে দেওয়া’র অভিযোগ তখনও ছিল তীব্র; উপচে পড়া শ্মশান, নদীতে ভাসমান বা তীরে পরিত্যক্ত দগ্ধ-অর্ধদগ্ধ শবদেহের ছবি প্রশ্ন তুলেছে, ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় নিশ্চিত ভাবেই অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান সেই অভিযোগকেই তীব্রতর করছে।
স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান ঠিক, না কি কেন্দ্রীয় সরকারের, সেই বিতর্কের মীমাংসা গলার জোরে, ব্যঙ্গোক্তির পারদর্শিতায় অথবা রাজনীতির চালে হওয়ার নয়। ভারতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান— বিশেষত কোভিড মৃত্যুর— বিষয়ে সংশয়ের বিলক্ষণ কারণ আছে। এ দেশে বেশির ভাগ মৃত্যুই হয় বাড়িতে, ফলে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ সব সময়েই সমস্যাজনক। কোভিডের মৃত্যুর হিসাবও হয়েছে ‘স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় অধিকতর মৃত্যু’-র হিসাব কষে। অতিমারি এবং তজ্জনিত লকডাউন যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাও যে অনেকের মৃত্যুর কারণ হতে পারে, সে কথাও স্পষ্ট। আবার, ‘স্বাভাবিক অবস্থা’-টি কোন বছরের, সেই তুলনাও এই হিসাবকে প্রভাবিত করতে পারে। তথ্য ও পরিসংখ্যানগত সমস্যা রাজনীতির বিষয় হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, ভারতের বাস্তব অন্য রকম। সরকার নিজের মুখরক্ষায় পরিসংখ্যানের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করে তাকে দিয়ে পছন্দসই কথাটি বলিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত। অতএব, এই প্রসঙ্গে রাহুল গান্ধী যে কথাটি বলেছেন, সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়— বহুদলীয় কমিটির অধীনে কোভিড মৃত্যু সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। প্রকৃত সংখ্যাটি জানা জরুরি— কারণ যাঁরা মৃত, তাঁরা শুধুই রাজনীতির উপজীব্য নন, তাঁরা এই দেশের নাগরিক ছিলেন।