এই দেশের বর্তমান শাসকরা অহঙ্কার করেন যে, তাঁহারা দেশকে ‘বিশ্ব গুরু’ বানাইতেছেন। জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লইবার পুরাতন স্বপ্ন এই বিচিত্র অভিধার মোড়কেই ফেরি করিয়া থাকেন তাঁহারা। তাহা করুন, যাহার যেমন রুচি ও ব্যবসাবুদ্ধি। কিন্তু এমন দেশটির রাজধানীতে অগণন মানুষ দিনের পর দিন আক্ষরিক অর্থে বেঘোরে মরিবেন? কোভিডের সংক্রমণ যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নাই, অসুস্থ হইলে চিকিৎসার সুযোগ নাই, শ্বাসকষ্টে অক্সিজেন নাই, মৃতপ্রায় রোগীর জন্যও হাসপাতালে স্থান নাই, মৃত্যুর পরে অন্ত্যেষ্টির জন্যও অনন্ত প্রতীক্ষায় বাধ্য হইতেছেন মৃতের পরিজনেরা, শ্মশানে স্থানাভাবে গাড়ি রাখিবার জন্য নির্ধারিত চত্বরে চিতা জ্বালাইয়া শবদাহ করিতে হইতেছে, এমনকি— লিখিতেও অক্ষর বাধিয়া যায়— দাহকর্মের জন্য সারিবদ্ধ ভাবে রাখিয়া দেওয়া মৃতদেহ টানিয়া ছিঁড়িয়া ভক্ষণের উপক্রম করিতেছে পথকুক্কুর। কল্পকাহিনি নহে, দুঃস্বপ্ন নহে, এই সকলই ঘটনা, যাহা ঘটিয়া চলিয়াছে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মহান ভারতের রাজধানী দিল্লি শহরে ও তাহার সন্নিহিত অঞ্চলে। অতিমারির আক্রমণে ভারতের বহু শহরই নাজেহাল, যে বিপন্নতার অনেকখানি মহামহিম রাষ্ট্রের অপদার্থতা ও অবহেলার পরিণাম, কিন্তু সেই বিস্তীর্ণ দুরবস্থার মধ্যেও খাস রাজধানীর চিত্রটি অবিশ্বাস্য রকমের মর্মান্তিক। এই অতিমারি এক দিন না এক দিন ইতিহাস হইবে, কিন্তু তাহার ইতিহাসে দিল্লির কাহিনি ভাবী কালের পাঠকের রাতের ঘুম কাড়িয়া লইবে। সেই ইতিহাস নরেন্দ্র মোদী এবং অরবিন্দ কেজরীবালকে ক্ষমা করিবে না।
দিল্লির প্রশাসন ও উন্নয়ন লইয়া কেন্দ্রীয় সরকার এবং দিল্লি সরকারের টানাপড়েনের কাহিনি সুবিদিত। তাহার কতটা প্রকৃত দ্বন্দ্ব আর কতখানি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা’, সেই রহস্যও বহুচর্চিত। কোভিডজনিত বিপর্যয় লইয়াও দুই সরকার পরস্পরকে দোষারোপ করিতেছে। কেজরীবাল ও তাঁহার সহকর্মীরা সঙ্কটের দায়ভাগ এড়াইতে পারেন না। সাধারণ অবস্থায় স্বাস্থ্য প্রশাসনের হাল কিছুটা ফিরাইতে তাঁহারা যে তাগিদ ও দক্ষতা দেখাইয়াছেন, অতিমারির মোকাবিলায় তাহার তিলমাত্র দেখা যায় নাই। সাধারণ স্বাস্থ্য পরিষেবার সহিত এই সঙ্কটের মোকাবিলার বিপুল পার্থক্যের কথা মনে রাখিয়াও বলিতেই হইবে, দিল্লি সরকার যাহা করিতে পারিত তাহাও করে নাই। তবে তাহাদের কেন্দ্রের সহিত একাসনে বসাইলে অবিচার হইবে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বহুগুণ বেশি, মোদী-শাহের সর্বগ্রাসী আধিপত্যের জমানায় তাহা আরও অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। সেই ক্ষমতার মৌতাতে তাঁহারা সতত মশগুল, কিন্তু নাগরিকদের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে সেই অনুপাতেই অনাগ্রহী। অতিমারি সারা দেশেই এই সত্যকে ভয়ানক ভাবে প্রকট করিয়া দিয়াছে। দিল্লি, রাজধানী বলিয়াই, তাহার প্রকটতম নিদর্শন। এই অতিনায়কদের লইয়া নূতন করিয়া বলিবার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নাই, কেবল দিল্লি তথা ভারতের নাগরিকদের এইটুকুই মনে করাইয়া দেওয়া চলে যে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার দিল্লির নূতন সংসদ ভবন নির্মাণ ও সন্নিহিত এলাকার উন্নয়ন করিবার ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ প্রকল্প রূপায়ণে বদ্ধপরিকর। নরককুণ্ডে বসিয়া নয়া ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণের এই তৎপরতা দেখিয়া, বাস্তবিকই, শ্বাস রুদ্ধ হয়।