মন্দারমণিতে বেআইনি হোটেল ভাঙার প্রশাসনিক নির্দেশ ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে যে কুনাট্য সম্প্রতি রচিত হল, তা নতুন করে আর বিস্ময় জাগায় না। পশ্চিমবঙ্গে এটিই এখন ঘোর বাস্তব। জাতীয় পরিবেশ আদালতের আড়াই বছরের পুরনো একটি নির্দেশকে কার্যকর করার উদ্যোগ করেছিল পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা প্রশাসন। অতঃপর হোটেল মালিকদের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, জেলাশাসকের নির্দেশ প্রত্যাহার, পরিশেষে হোটেল ভাঙার নির্দেশিকার উপর কলকাতা হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ— ঘটনাপ্রবাহ এগোল এই পথে। এবং ‘স্তম্ভিত’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, মন্দারমণিতে কোনও বুলডোজ়ার চলবে না। তাঁর ক্ষোভের কারণ, নবান্নকে না জানিয়েই জেলা প্রশাসন এই নির্দেশিকা জারি করেছে। সবিনয় জিজ্ঞাস্য— গত দু’দশক ধরে সিআরজ়েড আইন বা উপকূল বিধি ভেঙে যে একের পর এক হোটেল নির্মিত হয়েছে মন্দারমণিতে, সেই তথ্যটিও কি প্রশাসনের শীর্ষ মহলের কাছে ছিল না? কলকাতা থেকে দু’শো কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে গজিয়ে ওঠা এত সংখ্যক বেআইনি হোটেল নিয়ে কোনও তথ্যই যদি নবান্নে পৌঁছে না থাকে, তবে তা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা। অথবা, ধরে নিতে হয়, সমস্ত জেনেও প্রশাসন এত দিন নীরব থেকেছে। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে জেলা সফরকালে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই সমুদ্রের উপর নির্মাণ নিয়ে সরব হয়েছিলেন। অতঃপর সেই সচেতনতায় এমন দীর্ঘ যবনিকা পড়ল কেন, সেই উত্তরটিও খুঁজে বার করা প্রয়োজন।
এই উত্তর সম্ভবত লুকিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দলের গড়ে তোলা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি-সাম্রাজ্যের মধ্যে, যাকে এক নতুন মনসবদারি ব্যবস্থা বললে অত্যুক্তি হয় না। নদীর বালি, জঙ্গলের কাঠ, খাদানের কয়লার মতো সর্বজনীন সম্পদ লুটের মধ্য দিয়ে নানা দিকে এই সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছে। সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে প্রণামী পৌঁছে দিতে পারলেই একচ্ছত্র অধিকারটি পাকা হয়, এবং প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে রক্ষাকবচ মেলে। সাম্প্রতিক মন্দারমণির ঘটনাটিকেও সেই সংগঠিত দুর্নীতির অংশ হিসাবে দেখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে লুটের বিষয়— উপকূলের জমি। এবং, এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ উঠেছে হোটেল-মালিকরা পুলিশ-প্রশাসনের লোককে ‘সন্তুষ্ট’ করেই এত দিন অনায়াস ব্যবসা চালিয়েছেন। এই সামগ্রিক দুর্নীতি-ব্যবস্থা এতই মসৃণ যে, দেশের আইনও তাকে সহজে ভেদ করতে পারে না। মনসবদারদের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় জনরোষ সংঘটিত হয়েছে। অন্যতম উদাহরণ সন্দেশখালি। কিন্তু ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। ফলে, কমেনি অবৈধ কাজের প্রতি রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে যথেচ্ছ প্রশ্রয়দানের মাত্রাও। বরং কখনও ‘না-জানা’র অজুহাতে, কখনও রুটিরুজির প্রশ্ন তুলে, কখনও অন্য রাজ্য বা পূর্ববর্তী বাম জমানার দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে অবৈধ কাজকর্মকে ধামাচাপা দেওয়ার হাস্যকর প্রয়াস চলেছে।
মনে রাখা প্রয়োজন, মন্দারমণিতে যে হোটেল ভাঙার নির্দেশিকা জারি হয়েছিল, তা নিতান্তই জেলা প্রশাসনের কাজের অংশ। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সে কাজ নবান্নকে জানিয়ে করা হয়নি। অভিজ্ঞতা বলে, মুখ্যমন্ত্রী সচরাচর সমস্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে নিজেকে দেখতে পছন্দ করেন। অতএব বুঝতে হবে, তাঁর আপত্তির মূল কারণ— তাঁকে অন্ধকারে রেখে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন এই নির্দেশিকা জারি করেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জানেন না বলে প্রশাসনিক কাজ থমকে যাবে— এমনটা সুযুক্তির পরিচায়ক নয়, বিশেষত যে কাজ আইনলঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত। চরিত্রগত ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এককেন্দ্রিক দল হতে পারে, সেখানে দলনেত্রীর রায়ই শেষ কথা হতে পারে, কিন্তু সে ভাবে একটি গণতান্ত্রিক সরকার চালানো যায় না। এই সত্যটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বিস্মৃত হলে তা রাজ্যের পক্ষে অশনি সঙ্কেত।