বেহালা। লেক গার্ডেনস। বাঁশদ্রোণী। চৈত্র-বৈশাখের মহানগরে কয়েকটি রণাঙ্গন। গুলি, বোমা ইত্যাদি রকমারি দিব্যাস্ত্রের অকাতর প্রয়োগে ধুন্ধুমার সংঘর্ষের যে পরম্পরা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অব্যাহত, কলকাতাতেও তার তাপপ্রবাহ দুর্বার গতিতে বেড়ে চলেছে; রাজ্য পুড়লে রাজধানী অক্ষত থাকবে কেন? কোথায় সংঘাতের কারণ ঠিক কী, কী ভাবেই বা কার্যকারণ-সূত্রগুলো তাদের জাল বিস্তার করেছে, তার বিশদ কাহিনি অন্যত্র। কিন্তু এই রাজ্য তথা রাজধানীর দুর্ভাগা নাগরিকরা বিলক্ষণ জানেন, প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই এ-লড়াই প্রধানত এবং মূলত বখরার লড়াই। মুনাফার বখরা, তোলা আদায়ের বখরা, ক্ষমতার বখরা, ইত্যাদি ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও বিন্দুতে যে কোনও উদ্যোগ হোক না কেন, তার সঙ্গে যেটুকু অর্থ ব্যয় বা লগ্নি জড়িয়ে থাকুক না কেন, নিতান্ত ব্যতিক্রম না হলে সেই টাকা থেকে নিজের বখরা আদায়ের জন্য নানা মাপের হাঙর-কুমিরেরা সতত তৈরি। তাদের বিপুল এবং ক্রমবর্ধমান খাঁই মেটাতে না পারলে বা না চাইলেই নানা রকমের উপদ্রব, আক্রমণ, যা অনায়াসে মারাত্মক, এমনকি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। ‘সিন্ডিকেট’ অভিধাটি এই দুরাচারের প্রতীকমাত্র।
স্বভাবতই, এই দুর্বৃত্তদের নিজেদের মধ্যে রেষারেষিরও অন্ত নেই, এবং অনেক সময় তারা নিজেরাই নানাবিধ লগ্নির কারবারে ঢুকে পড়ে, যার ফলে গোটা বাজারটাই এক ভয়াবহ হিংস্র চেহারা নেয়, চোখের সামনে নিচ্ছে। শাসক দল এবং সরকারি প্রশাসনের নানা স্তরের কুশীলবরা অনেকেই যে এই অনাচারের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে, সেটা নিতান্ত সহজবোধ্য। এই ব্যাধি পুরনো, নিদেনপক্ষে এই শতাব্দীর সমবয়সি। কিন্তু গত এক দশকে রোগ যেখানে পৌঁছেছে, তা একেবারেই অভূতপূর্ব। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের মহামহিম নায়কনায়িকারা সে-কথা বিলক্ষণ জানেন। প্রবীণ সাংসদের ভদ্রাসনের সামনে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটেছে বলে তিনি শিহরিত, মর্মাহত, স্তম্ভিত, ইত্যাদি হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু বহুদর্শী রাজনীতিক তো নির্বোধ নন, অন্তরে অন্তরে তিনি কিছুমাত্র অবাক হয়েছেন কি?
এই কদর্য পরিবেশ কেবল সমাজকেই প্রতিনিয়ত রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে না, এর ফলে এক গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে রাজ্যের অর্থনীতির। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সাড়ম্বর বাণিজ্য সম্মেলন হয়ে গেল। মহা ধুমধাম, মহা হট্টগোল, এবং বিরাট বিরাট বিনিয়োগের ‘ইচ্ছা’ ঘোষণা, সবই যথারীতি সম্পন্ন হল। কিন্তু এমন ঘোষণা তো অনেক কাল প্রচারিত হয়ে আসছে, সত্যকার বিনিয়োগ কোথায়, কতটুকু হয়েছে? এবং, পরের প্রশ্ন, কেন হবে? বিনিয়োগের অনেক শর্ত থাকে। কিন্তু সে সব তো পরের কথা; যেখানে কোনও উদ্যোগ করতে গেলেই তোলাবাজদের দাপট সামলাতে হয়, যে দাপট এমনকি প্রাণসংশয় অবধি ডেকে আনতে পারে, পুলিশ-প্রশাসনের কাছে গিয়ে যার প্রতিকারের ভরসা থাকে না, সেখানে উদ্যোগীরা কেন লগ্নি করবেন? সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ ও দলের ভূতপূর্ব রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একটি আলোচনাসভায় এই সোজা প্রশ্নটি স্পষ্ট ভাষায় পেশ করেছেন। তাঁর বিভিন্ন কথা এবং কাজের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তর আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু এই প্রশ্নটি কেবল সঙ্গত নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য সরকার বা শাসক দলের নেতানেত্রীরা যদি সত্যই বিনিয়োগ চান, শিল্প চান, রাজ্যের উন্নয়ন চান, তা হলে এ-প্রশ্নকে উড়িয়ে দিলে বা এড়িয়ে গেলে চলবে না। তার সদুত্তর দিতে হবে। এবং একমাত্র সদুত্তর হল এই গুন্ডামির দুঃশাসনকে কঠোর ভাবে বন্ধ করা, প্রশাসন নামক হারিয়ে-যাওয়া বস্তুটিকে ফিরিয়ে আনা। সেটা কি তাঁরা পারবেন? কিংবা, চাইবেন?