তবে কি মানুষ বনাম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-এর লড়াইয়ে শেষ উইকেটও পড়ে গেল? বিখ্যাত কবিদের কবিতার ধাঁচে কৃত্রিম মেধা এমন ‘কবিতা’ লিখেছে, যে শ্রোতারা আসল-নকল ধরতেই পারেননি। বরং তাঁদের মনে হয়েছে, মেশিনের রচনাগুলো আরও সহজ, আরও সুন্দর। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের দুই গবেষকের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ায় বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছে। দাবা খেলায়, অঙ্ক কষায়, বহু আগেই মানুষের বুদ্ধিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে এআই। যে কোনও পরীক্ষার উত্তর লিখে দিচ্ছে গুছিয়ে, পরীক্ষকরা আসল-নকল বুঝতে হয়রান হচ্ছেন। খেলার ধারাভাষ্য থেকে চিঠিপত্র লেখা সবই চালিয়ে যাচ্ছে প্রায় নিখুঁত ভাবে। মানুষের নিজের বলতে যে ক’টি ক্ষমতা রয়ে গিয়েছিল বলে ভরসা ছিল, তার মধ্যে একটি কবিতা লেখা। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যে অন্যান্য ধরনের রচনায় এআই মানুষের সমান দক্ষতায় পৌঁছতে পারলেও, উচ্চমানের কবিতা কখনওই লিখতে পারবে না। কারণ, কবিতায় সৃজনশীলতা, শব্দ ব্যবহারে নতুনত্ব, অর্থের বোধ, এ সবই জটিল, সূক্ষ্ম। এখন সেই বিশ্বাসও নড়বড়ে হতে বসেছে। শেক্সপিয়র-সহ পাঁচ জন বিখ্যাত কবির লিখনশৈলীর অনুকরণে চ্যাটজিপিটি ৩.৫ তৈরি করেছিল পাঁচটি ‘কবিতা’। চ্যাটজিপিটি ৩.৫ মানুষের সঙ্গে মানুষের মতোই কথাবার্তা চালাতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, এমনকি নানা সৃজনশীল কাজেও সহায়তা করতে পারে। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, পাঁচটি মূল কবিতা, এবং পাঁচটি এআই-এর নির্মাণ শুনে শ্রোতারা ধরতে পারেননি, কোনটা কবির রচনা, কোনটা এআই-এর। এই প্রথম এমন ঘটল, জানিয়েছেন গবেষকরা।
এআই কি কবি হতে পারে? শব্দের অর্থ বা তার ব্যঞ্জনার ক্ষমতা বোঝা এআই-এর নেই। তার সামনে রয়েছে এক বিপুল তথ্যভান্ডার— ইন্টারনেটে বই, খবর-সহ প্রতি দিন যে শতসহস্র শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ যুক্ত হচ্ছে, সে সব কিছু তার পাঠ্য। কোন শব্দগুলি কী ভাবে ব্যবহৃত হয়, কী প্রসঙ্গে, কোন প্রশ্নের উত্তরে কোন কথাগুলি লেখা হয়, তার কোটি কোটি নিদর্শন থেকে এআই শব্দ-অর্থ সংযোগ, ও যথাযথ প্রয়োগের নকশাগুলি নিষ্কাশন করে। ঠাট্টা করে বলা হয় যে, যদি অসংখ্য বাঁদর অগণিত টাইপরাইটার নিয়ে অনন্তকাল টাইপ করতে থাকে, তা হলে এক সময়ে শেক্সপিয়রের সনেট লিখে ফেলতে পারবে। এআই-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত আনতাবড়ি নয়। শেক্সপিয়রের সনেটগুলি নিরীক্ষার পর এআই সেই ধাঁচে অগণিত সনেট লিখে ফেলতে পারে। যা পারে না তা হল, সেগুলির মধ্যে কোনগুলি সত্যিই উতরেছে, তা বাছাই করতে। এখনও মানুষই বাছাইয়ের কাজটি করে। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন, প্রতিটি রচয়িতাকে তার নিজের লেখার সমালোচকও হতে হবে। সে অর্থে হয়তো এআই-কে ‘কবি’ বলা চলে না। তবে পাঠকের দৃষ্টি থেকে দেখলে মনে হতে পারে, যে কবিতায় অর্থপূর্ণ বাক্যের বিন্যাস রয়েছে, যার ছন্দ মনে ঝঙ্কার তোলে, যার নান্দনিক গুণ মনকে খুশি করে, তাকে কবিতা বলব না-ই বা কেন?
তবে গবেষকদের উদ্বেগ অন্যত্র। মানব অভিজ্ঞতা, আবেগের প্রকাশ এআই মানুষের মতো সমান স্তরে করতে পারবে না, এই বিশ্বাস আজ আর টিকছে না। এআই-এর রচনা মানুষের রচনা বলে ভুল হচ্ছে। তাই সরকারের আইন করা দরকার, যাতে এআই-সৃষ্ট গদ্য-পদ্য প্রকাশ করলে সে তথ্য জানানো হয়। যাতে মানুষ জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দাবিটা যথার্থ, কিন্তু এই প্রত্যাশা প্রায় বেড়ালকে মাছ আগলাতে বলার মতো। এআই-এর শক্তিকে রাষ্ট্রশক্তি কাজে লাগাবে জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে, সে আশঙ্কা যথেষ্ট। মনে পড়ে জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের ‘ভার্সিফিকেটর’ যন্ত্র, যা অনর্গল অর্থহীন কথা সাজিয়ে গান তৈরি করত, যে গান ফিরত মুখে মুখে? সে গান যে কোনও মানুষের রচনা নয়, তা না জেনেই সানন্দে তা গাইত দেশের মানুষ। গবেষকরা দেখেছেন, এআই-রচিত কিছু ‘কবিতা’-কে শ্রোতারা ভাল নম্বরই দিয়েছেন, কিন্তু যখন তাঁদের জানানো হয়েছে যে ওই কবিতা মানুষের লেখা নয়, তার রচয়িতা এআই, তখন তাঁরা আর সে কবিতাগুলি অত পছন্দ করছেন না। সেটা আশ্চর্য নয়। কবিতা দিয়ে মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির, আর তার সঙ্গে মানব অস্তিত্বের গভীর, বিচিত্র সংযোগ অনুসন্ধান করে। কবির সঙ্গে কবিতার বিযুক্তি মানে ভাষার সঙ্গে অর্থের, বোধ ও বেদনার বিযুক্তি। সমগ্র মানবজাতির কাছে তা এক মস্ত সঙ্কট।