বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসায় মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়াছে রাজ্য সরকার। শীতলখুচির ঘটনায় মৃত চার জনের পরিবারপ্রতি পাঁচ লক্ষ টাকা, ভোট-পর্বে বাকি ৩৮ জন নিহতের পরিবার পাইয়াছে দুই লক্ষ করিয়া। তাহাতে নিহতের পরিবারের কতটুকু ক্ষতি পূরণ হইবে, ইহা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কি না, তাহা তর্কাতীত নহে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণের তত্ত্ব ও তাহার প্রয়োগ, দুই-ই জটিল হইয়া দাঁড়ায়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পের ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মানুষ ক্ষতিপূরণ পাইয়া থাকেন, তবে চরিত্রগত ভাবে তাহা মানবিক কারণে আর্থিক অনুদান। আবার ট্রেন দুর্ঘটনায় কাহারও প্রাণহানি হইলেও সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়, কারণ ট্রেনের সুষ্ঠু পরিবহণ ও যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব, সেই দায়িত্বে গাফিলতির জেরেই দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, সেই ব্যর্থতার দায় লইয়া সরকার নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়া থাকে।
একই যুক্তির নিরিখে রাজনৈতিক হিংসায় প্রাণহানির ঘটনায় সরকারের ক্ষতিপূরণ দেওয়াকে বিচার করিলে বলা যাইতে পারে যে, সরকারের কাজ রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, সেই কাজে ব্যর্থ হইয়াছে বলিয়াই হিংসা বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়াছে। সুতরাং এই ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণের পশ্চাতে আছে প্রশাসনের পরিস্থিতি সামলাইতে না পারিবার নীরব স্বীকারোক্তি। ঝরিয়া যাওয়া প্রাণটি ফিরিবে না, অর্থ দিয়া সরকার সেই ক্ষতি পূরণের স্পর্ধাও করিতেছে না, ইহা আসলে সরকারের দুঃখবোধ ও অপারগতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই যুক্তির সূত্র ধরিয়া কেহ বলিতে পারেন, সরকারের কাজ তো কেবল রাজনৈতিক হিংসা আটকানো নহে, যে কোনও প্রান্তে যে কোনও হিংসা বা হত্যা রুখিয়া দেওয়াও তাহার কাজ। সে ক্ষেত্রে এইরূপ ঘটনায় কোথাও কেহ নিহত বা মারাত্মক আহত হইলে, বা পাড়ায় দুই দল দুর্বৃত্তের কোন্দলে পড়িয়া কোনও নিরীহ নিরপরাধ নাগরিকের মৃত্যু হইলেও প্রশ্ন উঠিতে পারে, এই ক্ষেত্রেও কি সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে?
অন্য ক্ষেত্রে যাহাই হউক, রাজনৈতিক হিংসায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের দাবির ন্যায্যতা প্রশ্নটি স্বতন্ত্র গোত্রের। তাহা এই কারণেই যে, ইহার সহিত প্রশাসনের নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার, বিশেষত নির্বাচন-আবহে নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করিবার সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রশ্নটি ওতপ্রোত। রাজনৈতিক হিংসায় প্রাণহানির উদাহরণ হিসাবে আগে অন্য কয়েকটি রাজ্যের দৃষ্টান্ত আসিয়া পড়িত, ইদানীং পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত আর কোনও রাজ্যেই নির্বাচনকালীন এত রাজনৈতিক হিংসার বাতাবরণ চোখে পড়ে না। এই রাজনৈতিক হিংসা আটকানো রাজ্য প্রশাসনের অবশ্যকর্তব্য। হিংসার জেরে নাগরিকের প্রাণ গেলে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে বটে, তবে তাহা অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ সর্বাবস্থায় মনে রাখা: আইনশৃঙ্খলার রক্ষণ-সহ তাবৎ দায়িত্বসমূহ দক্ষ ভাবে, পূর্ণ দায়বদ্ধতার সহিত সম্পাদনে মন দিলে কোনও হিংসাই ঘটে না, নাগরিকের প্রাণ যায় না, ক্ষতিপূরণের প্রয়োজনও দেখা দেয় না। অতিমারিকালে ক্ষতিপূরণের অর্থে শীতলখুচি বা অন্যত্র নিহতের পরিবারের কিছুমাত্র সংস্থান হইলেও তাহা ভাল, কিন্তু প্রশাসনকে বুঝিতে হইবে, নাগরিকের ক্ষতি পূরণ পরের কথা, সামান্যতম ক্ষতির সম্ভাবনাও নির্মূল করাই প্রকৃত, প্রকৃষ্ট শাসন।