গমের ঘাটতি মেটাতে দরপত্রের মাধ্যমে বাজার থেকে সাড়ে ছ’লক্ষ টন বাড়তি চাল কেনার পরিকল্পনা করেছে রাজ্য সরকার। সাধারণত গণবণ্টন ব্যবস্থার খাদ্যশস্য চাষিদের থেকে ন্যায্য মূল্যে কেনে সরকার। বছরে পঞ্চান্ন লক্ষ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। হিতে বিপরীত ঘটবে, এমন আশঙ্কা যথেষ্ট। সরকার যদি বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ চাল কিনতে শুরু করে, তাতে বাজারে চালের দাম বাড়তে বাধ্য। এমনিতেই এ বছরে চালের দাম চড়া। রেশন-উপযোগী মোটা চাল বাজারে আসা কমে গিয়েছে। বেশি দামে সরকারকে বিক্রি করার আশায় বহু চাষি সম্ভবত মোটা ধান ঘরে রেখে দিয়েছেন। বাজারে ধান ও চালের চড়া দাম থেকে এ বছর তাঁরা লাভবান হবেন। তার উপরে তাঁদের একটি অংশ সহায়ক মূল্য পাবেন সরকারের থেকে। চালের মূল্যস্ফীতির প্রভাবও তাঁদের উপর পড়বে কম, কারণ সম্বৎসরের খাদ্যশস্যের চাহিদার একটি অংশ চাষিরা নিজেদের খেতের ফসল দিয়ে মেটান। তার সঙ্গে রেশনে প্রাপ্ত বিনা পয়সায় চালও পাবেন তাঁরা। এর বিপরীতে শ্রমজীবীরা আরও বিপন্ন হবেন, কারণ রেশনের চাল তাঁদের প্রয়োজনের অল্প অংশই মেটাতে পারে, অধিকাংশই বাজার থেকে কিনতে হয়। চালের দাম বাড়লে তাঁদের খাদ্যবাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। চাপে পড়বেন প্রধানত জমিহীন খেতমজুর এবং শহরে বাসরত শ্রমিকরা।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এখন অসহ। জ্বালানি, ভোজ্য তেল, আনাজ-সহ প্রতিটি খাদ্যবস্তুর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের তৈরি একটি সর্বভারতীয় সূচক অনুসারে, গত বছর মার্চ মাসের তুলনায় এ বছর ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে উনিশ শতাংশ, দুধ, ডিম, মাংসের দশ শতাংশের বেশি, জ্বালানির আট শতাংশ। খরচ বাড়ায় ক্রয় কমিয়েছেন বহু মানুষ, ফলে বাজারে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহও কমেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি প্রকল্পগুলিও— অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের খাবারের মান ও পরিমাণ, দু’টি নিয়েই অভিযোগ উঠেছে বার বার। মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়েনি। যার অর্থ, খাদ্যের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে আরও কম পুষ্টি মিলবে শিশুদের। একের পর এক সমীক্ষায় উদ্বেগজনক চিত্র উঠে আসছে— অপুষ্টির আশঙ্কাজনক হার, অত্যাবশ্যক দ্রব্যের জন্য পরিবারগুলির খরচে হ্রাস প্রভৃতি। কর্মচ্যুতি ও বেকারত্বও প্রবল। বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক আধিকারিক মনে করিয়েছেন, খাবারের দাম ১ শতাংশ বিন্দু বাড়লে আরও এক কোটি মানুষের অত্যন্ত দারিদ্রে পতিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে চালের মতো অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে কী হতে পারে, আন্দাজ করা কঠিন নয়। বাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপ নানা ভাবে ভারসাম্য নষ্ট করে। তবু চাষির স্বার্থে, এবং তাঁদের দাবির প্রাবল্যে, সহায়ক মূল্যে ধান কেনা একটি বাৎসরিক সরকারি রীতি হয়ে উঠেছে। অভাবী বিক্রি থেকে চাষিকে বাঁচাতে এই ব্যবস্থা। আজ দেখা যাচ্ছে, ধানের বাজারদর সরকারি দরের চেয়ে কুইন্টাল-প্রতি দু’শো টাকা কম থাকলেও চাষিরা সরকারি ব্যবস্থায় অনাস্থার ফলে ক্রয়কেন্দ্রে আসছেন না। অন্য দিকে, সরকার সরাসরি বাজার থেকে চাল কিনছে। এতে সরকারের কিছু টাকা বাঁচতে পারে, কিন্তু দরিদ্র মানুষ বাঁচবেন কি?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।