উত্তর-পূর্ব ভারত আপাতত সংঘর্ষ-সাগরে নিমজ্জমান। একাধিক রাজ্যের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হইয়াছে, বেশ কিছু প্রাণ বিনষ্ট হইয়াছে, সম্পত্তি ধ্বস্ত হইয়াছে। সাধারণ মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত বোধ করিতেছেন। তাঁহাদের নিভৃত বনাঞ্চলছায়া কেবল রাজ্য পুলিশের বুটের শব্দে শঙ্কিত হইতেছে না, সঙ্গে যোগ হইয়াছে সিআরপিএফ জওয়ানদের বজ্রকঠিন দাপট। অসম-মিজোরাম সীমান্ত সংঘর্ষ ইতিমধ্যে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের হেডলাইন, দুই রাজ্যের সীমানায় ছয় জন পুলিশ নিধনের সংবাদও আসিয়াছে। যদি কাহারও মনে প্রশ্ন জাগে, এমতাবস্থায় সেখানকার প্রশাসন কী করিতেছে, তবে তাঁহাদের জন্য একটি সংবাদই যথেষ্ট। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা নিজের কক্ষে বসিয়া সীমান্ত-হিংসার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করিতেছেন, সঙ্গে সরকারি বার্তা জারি রাখিতেছেন, কোনও মতেই জমি ছাড়া হইবে না! পরিস্থিতি শান্ত করিবার বদলে যদি হিংসা ছড়াইবার চেষ্টায় সরকারি ইন্ধন জারি রাখা হয়, তবে তাহার কী ফল হইতে পারে, ভাবিতে অসুবিধা হয় না।
বিস্ময়ের বিষয়, এই দুইটি রাজ্যের সরকার বন্ধুভাবাপন্ন, অন্তত রাজনৈতিক ভাবে নর্থ-ইস্ট ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স নামক এক ছত্রের ছায়ায়, এমনই জানে বাহিরের দুনিয়া। অথচ বিজেপি-শাসিত অসমের মুখ্যমন্ত্রী, এবং বিজেপি-মিত্র মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট-শাসিত মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা কিন্তু নিজেদের মধ্যে সমস্যা আলোচনা করিয়া সঙ্কট মিটাইবার কোনও চেষ্টাই করিলেন না, তথ্য-সংগ্রহ ও আদানপ্রদানের বন্দোবস্ত করিলেন না। বরং, দুই জনেই মাতিয়া উঠিলেন পরস্পরের মধ্যে টুইটার-যুদ্ধে, ভিডিয়ো শেয়ারের বিপজ্জনক খেলায়। ইহাও বিস্ময়ের যে, সংঘর্ষ চরমে উঠিবার দুই দিন আগেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সহিত তাঁহারা দুই জন সাক্ষাৎ করিয়াছেন, কী ভাবে আন্তঃরাজ্য সীমানা সঙ্কটের মীমাংসা সম্ভব, সেই বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন! শীর্ষতম স্তরে বৈঠকের পর ঘটনার এই দ্রুত অবনতি, এবং প্রশাসনের এই নির্বিকার ইন্ধন-দান— সহনাতীত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। জনজাতীয় গোষ্ঠী-সংঘর্ষে এমনিতেই এই অঞ্চলগুলি জেরবার, নূতন কথা নহে। তাহার সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে ক্রমবিকশিত অনুন্নয়নের ধারা, জমিসংক্রান্ত বিবাদ, নেতৃত্ব-সংঘাত। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পারস্পরিক অসহযোগিতার সুরটি উচ্চগ্রামে বাঁধা। এই রকম সামাজিক পরিস্থিতিতে যদি প্রশাসনিক স্তরেও অসহযোগই প্রধান নীতি হইয়া দাঁড়ায়, স্বয়ং কৃষ্ণ আসিলেও মথুরা-বিবাদ মিটিবে না। বিষয়টি যত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে রাজ্য-নেতৃত্বের উপর ভরসা না রাখিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরই উচিত যে কোনও প্রকারে সমাধানের ব্যবস্থা করা।
মানিতেই হইবে, এই সকল সমস্যার মূল খুঁজিতে হইলে চুয়াত্তর বৎসর পিছনে ফিরিতে হইবে। স্বাধীনতার সময়েই ব্রিটিশ কর্তাদের অজ্ঞতা এবং অবিবেচনার কারণে রাজ্যগুলির সীমানা যে ভাবে নির্ধারিত হইয়াছিল, তাহাতে যুক্তির বদলে ছিল চটজলদি বন্দোবস্তের ঔদ্ধত্য। ফল যাহা হইবার, হইয়াছে। অসম-মিজোরাম, অসম-অরুণাচল, ত্রিপুরা-মিজোরাম প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই ঘটনা। বহু মানুষ নিজভূমে পরবাসীর মতো থাকিতেছেন। বিষফোড়ার মতো এই বার যোগ হইল অসম-মিজোরাম সীমান্তে কড়া পাহারা, গাড়ির চেকিং, সন্তোষজনক পরিচয়-প্রমাণ এবং হেতু-যুক্তি ছাড়া সীমান্তে কড়া নিষেধাজ্ঞা। অসমের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে চেকিং ছাড়া তাঁহার রাজ্যে ঢুকিতে পারিবেন না অন্য রাজ্যের বাসিন্দা! কোনও দেশের দুই অঙ্গরাজ্যের মধ্যে এমন কাণ্ড কি চলিতে পারে? ভারতে আন্তঃরাজ্য সমস্যা আগেও হইয়াছে, কিন্তু তাহার এই রূপ ও প্রকৃতি নিতান্তই অভূতপূর্ব! পঁচাত্তর বৎসরের দোরগোড়ায় দাঁড়াইয়া দেখিতে হইতেছে, দেশের অন্তঃস্থলটি কতখানি ভঙ্গুর, ভয়াল এবং হিংস্র।