এক মাস পুজোর ছুটি। বিদ্যালয়গুলির প্রবেশদ্বার বন্ধ। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর চৌবেড়িয়া দীনবন্ধু বিদ্যালয় ব্যতিক্রম। সেখানে লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন থেকেই ক্লাস শুরু হয়েছে। উলটপুরাণই বটে। যেখানে রাজ্য সরকার এক পুজোর ছুটি সমাপ্ত হওয়ার আগেই আগামী বছরের ছুটির ঘোষণা করে দেয়, সপ্তাহান্তে ছুটি পড়লে তার লেজা-মুড়োয় আরও ক’দিন বাড়তি ছুটি জুড়ে সরকারি কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের টানা অবকাশ যাপনের সুবন্দোবস্ত করে দেয়, সেখানে এই বিদ্যালয়ের এমন সৃষ্টিছাড়া আচরণ কেন? জানা গিয়েছে, বিদ্যালয়ে দুর্গাপুজোর পূর্বে যে পরীক্ষা হয়েছিল, তাতে কিছু পড়ুয়া উত্তীর্ণ হতে পারেনি। মূলত তাদের সুবিধার্থেই এই ক্লাসের আয়োজন হলেও, সার্বিক ভাবে সমস্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়ার প্রস্তুতি এবং সিলেবাস শেষ করার বিষয়টিতেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক-সহ অন্য শিক্ষকরা নিয়মিত আসছেন, পড়ুয়াদের উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
একেই বলে দায়িত্ববোধ। শিক্ষকতা পেশার প্রতি পরতের সঙ্গে যে দায়িত্ববোধ ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে। শিক্ষক শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন, এবং তার বিনিময়ে মাসান্তে বেতন পাবেন— এই সরলরৈখিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই পেশার সমস্ত স্তরকে ধরা সম্ভব নয়। শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। সময়ের সঙ্গে, বিশেষত সাম্প্রতিক অপ্রীতিকর ঘটনাক্রমের আঘাতে এই পেশা নানা দিক থেকে জর্জরিত হলেও অগণিত শিশুর ভবিষ্যতের সুতোটি আজও মূলত শিক্ষকদের হাতেই ধরা থাকে। পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ গড়তে তাঁকে কখনও পথপ্রদর্শক, কখনও অভিভাবক, কখনও বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। বহু ক্ষেত্রেই পেশাগত সম্পর্ক ছাপিয়ে এক স্নেহ, শ্রদ্ধা, নির্ভরতার বন্ধনে বাঁধা পড়ে দুই পক্ষ। সেই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে ছুটির আরামের চেয়ে ঢের বেশি জরুরি প্রতিপন্ন হয় নির্ধারিত সময়ের বাইরে গিয়ে পরীক্ষার জন্য ছাত্রদের প্রস্তুত করা। কোভিডকালেও অনেক শিক্ষক সেই তাড়নাতেই পড়ুয়াদের বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনার অভ্যাসটি বজায় রেখেছিলেন। বর্তমানে রাজনীতি এবং স্বার্থসর্বস্বতা অন্য ক্ষেত্রগুলির মতোই শিক্ষকতাকেও গ্রাস করছে। বহু শিক্ষক নিজ কর্তব্য ভুলে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়েছেন। কিন্তু সকলেই যে সেই (কু)পথের শরিক হননি, গোপালনগরের স্কুলটির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তারই উদাহরণ।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চোখে কি এই উদাহরণগুলি কোনও বার্তা বয়ে আনছে? তারা কি অনুধাবন করছে, পঠনপাঠনের যে অপরিমেয় ক্ষতি গত দু’বছরে হয়েছে, সেখানে ছুটির এমন জোয়ার পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিরাট প্রশ্ন তুলে দিতে পারে? এক দিকে, অধিকাংশ স্কুলে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকসংখ্যা লক্ষণীয় ভাবে কম, শিক্ষকের অভাবে উঁচু ক্লাসে বিজ্ঞান পড়ানো বন্ধ রাখতে হয়েছে, এমন উদাহরণও প্রচুর। অন্য দিকে, বেআইনি শিক্ষক নিয়োগের ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে রাজ্যের মাথা হেঁট করেছে। তা সত্ত্বেও এখনও অবধি শিক্ষা নিয়ে সরকারি স্তরে মৌখিক কিছু আশ্বাস ছাড়া যথেষ্ট উদ্যোগী হওয়ার নিদর্শন মিলল না। ছুটির জনমোহিনী রাজনীতি ভোটবাক্স ভরাতে পারে, কিন্তু পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ গড়তে পারে না। স্বয়ং রাজ্য সরকার যে এই সত্য অনুধাবন করতে পারছে না, তা বিস্ময়কর বইকি।