Sourced by the ABP
সময় তখনও গত শতাব্দীর সীমানা টপকে একুশ শতকে প্রবেশ করেনি। এক নাগরিক কবিয়াল তাঁর গানে লিখেছিলেন, “বাহবা সাবাস বড়দের দল, এই তো চাই— ছোটরা খেলবে, আসুন আমরা বোমা বানাই।” ব্যঙ্গের মোড়কে চূড়ান্ত অসহায়তা ফুটে উঠেছিল বল ভেবে বোমা নিয়ে খেলতে গিয়ে কয়েকটি শিশুর জখম হওয়ার ঘটনায়। তার পর ভাগীরথী-হুগলি দিয়ে বয়ে গিয়েছে বহু জল, রাজ্যে সর্বহারা গিয়ে মা-মাটি-মানুষ এসেছে, শুধু বোমাকে বল ভাবার মতো নির্বোধ শিশুরা থেকেই গিয়েছে। দড়ি দিয়ে মোড়া গোলাকার বস্তুটি যে ছোটদের খেলনা নয়, বড়দের ‘খেলা হবে’ নামক প্রতিশ্রুতিরক্ষার আয়ুধ, সে কথা বোঝার মতো বড় হয়ে ওঠার আগেই সেই বোমা ফেটে মারা গিয়েছে, জখম হয়েছে অনেকগুলি শিশু— বহু বছর ধরে, বহু ঘটনায়। উত্তর ২৪ পরগনার ইউসুব মোল্লা নামক চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রও নাম লেখাল সেই শিশুদের তালিকায়। বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হয়ে সে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বল ভেবে বোমাটি কুড়িয়ে এনেছিল সে।
সে একা নয়, এই বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে যে লাগামছাড়া হিংসা, সন্ত্রাস বিভিন্ন জেলায় চলছে, তার শিকার হয়েছে বহু শিশু। জমিয়ে রাখা অব্যবহৃত বোমাকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে অনেকেরই অঙ্গ খোয়া যাওয়ার উপক্রম। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির হিংস্রতা এখন শুধু গোটা দেশের নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও আলোচনার বিষয় হয়েছে— লন্ডন থেকে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকাতেও সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসা নিয়ে। এই শিশুরা সেই হিংসারই শিকার। এ রাজ্যে অস্ত্র বস্তুটি এমনই সহজলভ্য যে, সেগুলি যত্রতত্র ফেলে রাখা চলে। এমন ভাবে, যাতে তা শিশুদের নাগালেরও বাইরে না থাকে। অনুমান করা চলে যে, যত বড় দুষ্কৃতীই হোক না কেন, কেউ শিশুকে হত্যা করার জন্য অস্ত্রের আয়োজন করে না। বলা যায় না, হয়তো কোনও কোনও ক্ষেত্রে অতি নিকটজনের ফেলে রাখা বোমাতেই আহত বা নিহত হয়েছিল কোনও শিশু। আগুনের এটাই ধর্ম— সে যখন পোড়ায়, তখন বাধবিচার করে না। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সেই আগুনই জ্বলছে।
সেই আগুনের পিছনে রাজনীতির ভূমিকা মারাত্মক, বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কালেদিনে রাজনীতি আরও বেশি হিংসাপ্রবণ হয়ে উঠছে, দুষ্কৃতীরা আরও ভয়ডরহীন হচ্ছে, তাতেও সন্দেহ নেই। তার পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনরীতি এবং দলীয় রাজনীতির মস্ত ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু, ভুললে চলবে না যে, বর্তমান নিবন্ধের শুরুতে যে গানটির উল্লেখ করা হয়েছে, তা ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের ঢের আগে লেখা। নারকেল দড়ি-বাঁধা বোমা তখনও শিশুদের কাছে সহজলভ্যই ছিল। বাম জমানায় হয়েছে, ফলে এই জমানাতেও হলে দোষ নেই, এমন ভয়াবহ যুক্তি বর্জনীয়। দুই জমানার ধারাবাহিকতা শুধু বলে দেয় যে, পুলিশ প্রশাসন তখনও নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হত, এখনও হচ্ছে। রাজ্য বারণাবতে পরিণত হয়েছে, তার পিছনে পুলিশের দায় অনস্বীকার্য। অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ না করা থেকে অস্ত্র উদ্ধারে ব্যর্থতা, প্রতিটি দায়ই পুলিশকে নিতে হবে। শিশুদের জীবন সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বও কি পুলিশ পালন করতে পারে না?