ভারতে ‘মধ্যবিত্ত’ শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই কমছে, অর্থনীতিবিদরা এ কথা বলে আসছেন বেশ কিছু দিন ধরেই। সম্প্রতি তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল ভারতে ফাস্ট-মুভিং কনজ়িউমার গুডস (এফএমসিজি) বা ভোগ্যপণ্যের বাজারের অন্যতম বড় এক সংস্থার কর্ণধারের মুখে। তিনি বললেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণিই তাঁদের ব্যবসায়িক বাজারের প্রধান ক্রেতা— তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে সংস্থার বাণিজ্যের উপরে। আর এক বৃহৎ সংস্থার কর্ণধারও গত মে মাসে এমনই একটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সংস্থা অবশ্য পরে সেই কথাটি প্রত্যাহার করে নেয়; বলে যে, তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ বা বিশ্লেষকদের তুলনায় বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার শীর্ষকর্তারা অর্থব্যবস্থা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সচরাচর অনেক বেশি সতর্ক থাকেন। কারণ, অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে নেতিবাচক বক্তব্য পেশ করলে নয়াদিল্লির বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা। সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়েও যখন তাঁরা মুখ খুলছেন, তখন বিপদের মাত্রাটি আঁচ করা যায়। মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা সম্বন্ধে আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে সুলভ আবাসন ও তুলনায় কম দামি গাড়ির বাজারের দিকে তাকালেও। ভারতে গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলির ঘরে বিক্রি না-হওয়া গাড়ির সংখ্যা সর্বকালীন রেকর্ড স্পর্শ করেছে। অন্য দিকে, বিলাসবহুল আবাসন ও বিলাসবহুল গাড়ির বিক্রি অব্যাহত। অর্থাৎ, ক্রয়ক্ষমতায় টান পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই।
এই জাতীয় সমালোচনার মুখে পড়লে অর্থব্যবস্থার কর্ণধাররা সাধারণত জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের কথা মনে করিয়ে দেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, অতিবৃহৎ অর্থব্যবস্থা হিসাবে সাত শতাংশের কাছাকাছি বৃদ্ধির হার কোনও অবস্থাতেই ফেলনা নয়। কিন্তু, একই সঙ্গে এ কথাটিও মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, বৃদ্ধির হারের হিসাবে আসলে অর্থব্যবস্থার অসুখের ছবি আদৌ ধরা পড়ে না। কেন, সেই প্রশ্নের অকাট্য উত্তর অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি কিছু দিন আগেই দিয়েছেন। তাঁদের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে, ভারতে আর্থিক অসাম্যের মাত্রা ঔপনিবেশিক আমলের শীর্ষ স্তর স্পর্শ করেছে। ফলে, অর্থব্যবস্থায় যে বৃদ্ধি ঘটছে, তার সর্বজনীন সুষম বণ্টন হচ্ছে না, সমৃদ্ধি সীমিত থাকছে মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যেই। অতিধনীদের একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে বিপুল আয়বৃদ্ধি ঘটলেও তাঁদের ক্রয়ের পরিমাণ একটি সীমায় আটকে থাকে— যতই আয় হোক, এক জন মানুষ আর কত ভোগ করবেন! মধ্যবিত্ত বা তার নীচের শ্রেণির আয়বৃদ্ধি ঘটলে তার সিংহভাগই ভোগব্যয়ে খরচ হয়। ফলে, বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অর্থব্যবস্থাও সচল থাকে। আর্থিক অসাম্য শেষ অবধি অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এই কথাটি শীর্ষনেতারা বুঝলে মঙ্গল।
ভারতে আয়বণ্টনের প্রধানতম পথ শ্রমের বাজার। কারণ, এ দেশের অতি অল্পসংখ্যক মানুষেরই মূলধনি আয় আছে; সিংহভাগেরই আয়ের একমাত্র পথ বেতন। ভারতের কাজের বাজারের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কেন অসাম্য বেড়েই চলেছে। নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতিমাফিক বছরে এক কোটি নতুন চাকরি দূরে থাকুক, বহু ক্ষেত্রেই কাজের বাজারে ক্রমসঙ্কোচন ঘটছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সিংহভাগ ঘটছে পারিবারিক ক্ষেত্রে বিনা বেতনের কাজে স্বনিযুক্তিতে। যাঁরা বেতন পাচ্ছেন, তাঁদেরও বেতনবৃদ্ধির হার অতি কম; প্রকৃত আয়ের হিসাবে অনেকেরই বেতন হ্রাস পাচ্ছে। এই অবস্থায় বাজারে চাহিদা না থাকাই স্বাভাবিক। এবং, পরিস্থিতিটি হঠাৎ এমন ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি— ২০১৫ সাল থেকেই অর্থব্যবস্থায় চাহিদা ভঙ্গের বিভিন্ন ছবি ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সূচকে। তার কিছু সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি; কিছু ক্ষেত্রে পাল্টা ব্যাখ্যা পেশ করেছে। কিন্তু, পরিসংখ্যান গোপন করলেই তো বাস্তব পাল্টে যায় না। সেই বাস্তবেরই প্রকাশ ঘটছে বাণিজ্যিক সংস্থার কর্ণধারদের কথায়।