—প্রতীকী চিত্র।
অসত্যই কেবল মিথ্যা নয়, সত্য গোপনও মিথ্যাচার— অন্তত রাজনীতিতে। এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনটি (২০১৯) নিয়ে যে উত্তুঙ্গ আলোচনা চলছে, এবং আগামী লোকসভা ভোটের আগেই তা বলবৎ করে সকল ‘হিন্দু উদ্বাস্তু’কে আশ্বাস দেওয়ার কথা হচ্ছে— তার মধ্যে কিছু সত্য গোপন করা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, এই আইন ‘অনুপ্রবেশকারী’দের তাড়িয়ে ‘শরণার্থী’দের নাগরিক করবে। স্পষ্টতই, অনুপ্রবেশকারীর তালিকায় আছেন মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা, কেননা এই আইন বলছে অন্যান্য ধর্মের মানুষদের রক্ষার কথা, যদি তাঁরা একটি বিশেষ সময়ের আগে এসে থাকেন। এখানে কিছু কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার। প্রথমত, মুসলমানদের এই ভাবে বাদ দেওয়া স্পষ্টত ভারতীয় সংবিধানের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ এবং ২১ নম্বর ধারার বিরোধিতা— এ দেশে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকতার অধিকারে বৈষম্য চলে না। বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও উঠে আসছে সঙ্গত ভাবেই। দ্বিতীয়ত, অন্যদের জন্যও আবেদনটি কিসের ভিত্তিতে করা যাবে তা অস্পষ্ট, কেননা হিন্দু শিখ জৈন বৌদ্ধ যে ধর্মের মানুষই হোন না কেন, তাঁদের দেশ ছাড়ার কোনও নথি দেখানো সহজ নয়। বাস্তবিক, এই কারণেই এনআরসি প্রয়োগ আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসম প্রদেশে বহু লক্ষ মানুষ, যার মধ্যে প্রচুরসংখ্যক হিন্দু, বিপন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেন। নাগরিকত্ব আইনের ধারাগুলিও এখনও পর্যন্ত যেমন আছে, তাতে বৈধ নথিপত্র দেখানো ছাড়া এগোনোর রাস্তা নেই। লক্ষণীয়, বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ আমলে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছিল যে ভাবে, তাতে সমস্ত উদ্বাস্তুকেই ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দেওয়া হয়েছিল। তার থেকে নাগরিকত্বে উন্নীত হওয়ার একমাত্র পথ ছিল সীমান্তের ও পারে নাগরিকতা ও সীমান্তপারের বৈধ নথির প্রদর্শন। আজ সেই সংশ্লিষ্ট ধারাগুলি সংশোধনের আগে এই প্রতিশ্রুতি কিংবা আশ্বাস নেহাত লোক-ঠকানো রাজনীতি।
পশ্চিমবঙ্গে এসে যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত কয়েক মাস এই প্রচার চালিয়েছেন, এবং আগামী কিছু মাসও চালাবেন, তার হেতু সহজবোধ্য। পশ্চিমবঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক মতুয়া গোষ্ঠী, যাঁরা এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছেন। অন্তত ৩০টি বিধানসভা কেন্দ্র ও দুইটি লোকসভা কেন্দ্রের নির্ণায়ক মতুয়াদের কেন্দ্র করে কয়েক দশক যাবৎ এই জলঘোলানো রাজনীতি চলে আসছে, যা বিজেপি আমলে ন্যক্কারজনক আকার ধারণ করেছে। সুদীর্ঘ কালের বাম রাজনীতির সমর্থক এই সমাজ ২০১১ সালের আগেই তৃণমূল কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থনভিত্তি হিসাবে উঠে আসে। ২০১৯ সালের আগে মতুয়া মহাসঙ্ঘ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে ছবিটি পাল্টায়, একটি অংশ তৃণমূল অনুসারী থাকলেও অন্য অংশটি শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে বিজেপি সমর্থক হয়ে ওঠে। শান্তনু ঠাকুরের বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব দান কিংবা সাম্প্রতিক কালে মমতাবালা ঠাকুরকে রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ পদে আনার দাবিটিকে এই দিক থেকে দেখা জরুরি।
মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থানটিও বেশ সমস্যাজনক। বারংবার তিনি ও তাঁরা বলে চলেছেন, নাগরিকত্ব কোনও সমস্যাই নয়, অথচ কে না জানে এ দেশে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, কোনওটিই শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্বের চিহ্নক নয়। ফলে মতুয়া সমাজের উদ্বেগ, অশান্তি ও সঙ্কটকে মনগড়া বলা চলে না। অন্য দিকে এই রাজ্যে, বিশেষত উত্তরবঙ্গে এমন নিম্নবর্ণ গোষ্ঠীও আছে যারা পরবর্তী কালে আগত মতুয়াদের জমিজায়গা-সহ কোনও অধিকারই ছেড়ে দিতে ঘোর অনিচ্ছুক। দেশভাগের ভয়ঙ্কর পরিণতি আজও যে রাজ্যে প্রত্যহ প্রবহমান, এবং যে প্রবাহে পরতে পরতে মিশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সেখানে নাগরিকত্বের এই অন্যায় রাজনীতি বিষমন্থনের প্রকৃষ্ট প্রকরণ।