সাতান্ন বছর পরে আবার এক দেশ এক নির্বাচন হতে চলেছে ২০২৯ সালে: কেন্দ্রীয় সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য। কিংবা, পারদর্শী আইনজীবী কপিল সিব্বলের ভাষায়, পরবর্তী ‘জুমলা’। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত, পুরসভা, সব ভোট তখন এক সঙ্গে হবে, এক ভোটে নয় যদিও। ইতিমধ্যেই এই মর্মে ‘সুপারিশ’ হয়ে গিয়েছে, পরবর্তী পর্যায়ে প্রস্তাব এনে পাশ করানোর পালা। কিন্তু বিষয়টির অর্থ ও গুরুত্ব যে-হেতু অত্যন্ত গভীর এবং ব্যাপ্ত, ‘প্রস্তাব’ আনার অর্থ আসলে অন্তত পনেরোটি সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা করা, আপাতদৃষ্টিতে যা তিনটি সংস্কার প্রস্তাবের মাধ্যমে সংসদে পেশ করতে চলেছে তৃতীয় দফার নরেন্দ্র মোদী সরকার। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রমানাথ কোবিন্দ কমিটির শিরোপাযুক্ত যে রিপোর্ট গত মাসে ক্যাবিনেট স্বীকৃতি পেল— ইতিমধ্যেই প্রায় দুই ডজন দল, কংগ্রেস-সহ, তার প্রবল বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এই সংস্কার কেবল অপ্রয়োজনীয় এবং গোলমেলে নয়, এর মধ্যে আছে চূড়ান্ত অসাংবিধানিকতা। নানা স্তরে, নানা যুক্তিতে এই অসাংবিধানিকতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হচ্ছে: যেমন, এই ভাবে যদি ২০২৯ সালে ভোট এক সঙ্গে করতে হয়, তা হলে অন্তত ১৭টি রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ ফুরোনোর আগেই সে সকল রাজ্যে আবার নতুন করে বিধানসভার ভোট করাতে হবে। অর্থাৎ এতগুলি জননির্বাচিত বিধানসভাকে ভেঙে দেওয়া হবে— যা সম্পূর্ণ রাজ্যগুলির সাংবিধানিক অধিকারের বিরোধী। এবং যা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের ঘোরতর বিপ্রতীপ। সে ক্ষেত্রে, ভারতের সংবিধান তারা ‘পাল্টাতে’ চলেছে বলে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অনেক দিনই যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, তা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিরোধী পক্ষের আরও কয়েকটি অভিযোগ যথেষ্ট গুরুতর, প্রণিধানযোগ্য। যেমন, সর্বভারতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে স্পষ্টাক্ষরে বলেছেন যে তাঁর দল মনে করে, এই সংস্কার প্রচেষ্টা গণতন্ত্রবিরোধী। গণতান্ত্রিক ভাবে গঠিত সরকার ভেঙে দেওয়া এই যুক্তির একটি দিক হলে, অন্য দিকটি আছে প্রতিটি স্তরের নির্বাচনকে যথাযথ ও আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে। এক সঙ্গে নানা ভোট এক সঙ্গে হলে সেই গুরুত্ব যে খর্বিত হয়, কিংবা সেই গুরুত্ব খর্ব করার জন্যই যে এই সংস্কারটির প্রয়াস, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। জাতীয় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলিকে এক সঙ্গে নির্বাচনী তালিকা তৈরি করতে হবে— যা এই মুহূর্তে কার্যত অসম্ভব। একমাত্র সাংবিধানিক ধারা পাল্টেই সে কাজের দিকে এগোতে হবে। ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, বিহার থেকেও বিরোধী নেতারা জানিয়েছেন, যে ভাবে জেএমএম-কে কিংবা এনসিপি-কে কিংবা বিজেডি-কে ভেঙে দিতে চেয়েছে/পেরেছে বিজেপি, ঠিক একই লক্ষ্যে এই সংস্কার আনতে তারা বদ্ধপরিকর। প্রদেশভিত্তিক দলগুলিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে ও প্রাদেশিক ভোটের গুরুত্ব বিনষ্ট করে বিজেপি যা করতে চাইছে— তা হল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভেবে এককেন্দ্রিক একদলীয় স্বৈরবাদের দিকে হাঁটা।
কোন দিকে হাঁটা কিংবা হাঁটানোর লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার, ‘এক দেশ এক ভোট’ বার্তার মধ্যেই সেই বাসনা উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট। তবে কিনা, শেষ পর্যন্ত হাঁটার পথ অমসৃণ ও কণ্টকপূর্ণ হতে চলেছে, সে কথা সম্ভবত বিজেপিও জানে। পঞ্চাশ শতাংশ রাজ্যে এই প্রস্তাব পাশ করাতে না পারলে এত গুরুতর সংবিধান সংশোধন সম্ভবই নয়। তদুপরি, সংসদেও দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাবকে পাশ করানো আবশ্যিক। এই মুহূর্তে লোকসভায় সে কাজ সহজ নয়। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক যে, যে-হেতু একে একে সংবিধান-সম্পর্কিত বিলগুলি আনা হবে, সরকারের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যক্রম বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক না থাকলে বিরোধী পক্ষ তা আটকাতে পারবে না। এর জন্য দরকার, ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রচার ও দৃঢ় মনোভাব।