ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বৎসর বাজেটে গণরসুইয়ের জন্য একশত কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন। স্বল্পমূল্যে রান্না-করা খাবার বিক্রয় করিবার এই প্রকল্পে টাকার অঙ্ক খুব বেশি নহে, ক্ষুধানিবারণ বা পুষ্টিবিধানের সম্ভাবনাও সীমিত। এমনকি উদ্ভাবনী চিন্তারও পরিচয় ইহাতে নাই— লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও বামপন্থী সংগঠনগুলি রান্না-করা খাবার নিয়মিত বিতরণ করিয়াছিল। তবু ‘মা’ প্রকল্পটি মনোযোগ দাবি করে, কারণ তাহার দ্বারা শহরবাসী দরিদ্র এবং নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্যের অভাবকে স্বীকার করিল সরকার। এবং তাহার প্রতিকার যে সরকারের কর্তব্য, তাহাও মানিল। নাগরিকের, বিশেষত দরিদ্রের, কোনও চাহিদা তীব্র হইলে তাহার অনুরণন সরকারি নীতিতে পড়িবে, গণতন্ত্রে ইহাই প্রত্যাশিত। অতিমারি-পরবর্তী রাজ্য বাজেটে তাহার অন্তত কিছু ইঙ্গিত মিলিয়াছে। কেন্দ্রের বাজেটে যাহা কার্যত অনুপস্থিত।
গত বৎসর অতিমারি-জনিত কর্মহীনতা, অর্ধাহার-অপুষ্টি, শিক্ষাবঞ্চনা ও চিকিৎসার দুষ্প্রাপ্যতার অভিঘাতে দেশ আন্দোলিত হইয়াছে। কিন্তু, বিপর্যয়ের সূচনা হইয়াছিল পূর্বেই— বেকারত্ব ও আয় হ্রাস গত কয়েক বৎসর ধরিয়াই দেশের অধিকাংশ মানুষকে বিপন্ন করিয়াছে। রোজগার কমিবার ফলে অত্যাবশ্যক পণ্য ক্রয় কমিয়াছে, ক্ষুধা, অপুষ্টি ও রক্তাল্পতা বাড়িয়াছে— নানা সমীক্ষায় এই সকল তথ্য প্রকাশিত। অতিমারিতে সেই বিপন্নতা আরও তীব্র হইবার ফলে আজ মানুষের সরকার-নির্ভরতা বাড়িয়াছে। অথচ, কেন্দ্রীয় বাজেটে তাহার কোনও প্রতিফলন নাই। বরাদ্দ কমিয়াছে পুষ্টি প্রকল্পে এবং মহিলা ও শিশু কল্যাণে; চিকিৎসা পরিকাঠামোয় টাকা বাড়িলেও স্বাস্থ্য পরিষেবার দৈনন্দিন চাহিদার বরাদ্দ কমিয়াছে। খাদ্য বা চিকিৎসার নিরাপত্তাহীনতা কেন্দ্রীয় বাজেটে ছাপ ফেলে নাই। তুলনায় রাজ্য বাজেটে দরিদ্রের চাহিদা কিছুটা হইলেও স্বীকৃতি পাইয়াছে। রেশন হইতে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য কেন্দ্র বন্ধ করিলেও রাজ্য করে নাই; ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বিনামূল্যে চিকিৎসার আশ্বাস দিয়াছে; শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা এবং সার্বিক পেনশনের আশ্বাস মিলিয়াছে।
এই সকল প্রতিশ্রুতি পূরণ হইবে কি না, সেই উদ্বেগ আছে। রাজ্যের ঋণের উপর আরও ঋণের বোঝা চাপিতেছে। এমন সময়ে জনমুখী নানা প্রকল্পে সরকারের ব্যয়বৃদ্ধির ঘোষণা ‘নির্বাচনী চমক’ মনে হইতে পারে। অর্থাভাবের উদ্বেগ অতিকায় হইতে হইতে অপর সকল উদ্বেগকে ঢাকিয়া দেয়। ফলে, রাজ্য বাজেটকে কেন্দ্র করিয়া এই প্রশ্নগুলি উঠিতেছে। কিন্তু বাজেটের আরও একটি অর্থ কি নাই? অসংখ্য চাহিদা, অগণিত দাবির সম্মুখে দাঁড়াইয়া সরকারকে বাজেট তৈরি করিতে হয়। কোন চাহিদাটিকে সরকার অগ্রাধিকার দিল, কাহার দাবি মিটাইতে দায়বদ্ধ হইল, সমস্যার সমাধানের জন্য নূতন কী কৌশল গ্রহণ করিল, সকলই প্রকাশিত হয়। রাজ্য সরকার দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের খাদ্য নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়াছে, প্রশাসনকে আরও তৎপর করিতে জেলায়, পাড়ায় শিবিরের কৌশল ভাবিয়াছে, এবং এই সংঘাত-বিদীর্ণ সময়েও মাদ্রাসা ও রাজবংশী ভাষার স্কুলকে অনুমোদন দিয়াছে। ইহা নীতির যথাযথ দিশা, সন্দেহ নাই। এখন প্রশ্ন সদিচ্ছার। এই সকল ঘোষণা কেবল ভোট পাইবার কৌশল হইয়া থাকিয়া যাইবে, না কি তাহার বাস্তবিক রূপায়ণ হইবে, তাহার উত্তর ক্রমশ মিলিবে।