BJP

সঙ্কল্পের পরিশ্রম নাই

প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণ লইয়া সস্তা কৌতুক পরিহার্য, কিন্তু বিজেপির বড় মেজো ছোট নেতানেত্রীর আচরণে বঙ্গসংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধা দূরস্থান, ন্যূনতম আগ্রহেরও প্রমাণ দুর্লভ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৫১
Share:

প্রতীকী ছবি।

ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে প্রস্তুত দলীয় ইস্তাহারের নাম দিয়াছে ‘সোনার বাংলা সঙ্কল্প পত্র’। অভিধানে সঙ্কল্পের অর্থ: ‘আমি ইহা করিবই’ এইরূপ মানসব্যাপার— এক কথায়, ‘মানসকর্ম’। মানসকর্ম এবং কর্ম এক নহে। ‘আমরা সোনার বাংলা গড়িবই’ এইরূপ মানসব্যাপার এবং সত্য সত্যই সোনার বাংলা গড়িবার চেষ্টা— দুইয়ের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব। কিন্তু তাহার জন্য বিজেপিকে স্বতন্ত্র ভাবে কটাক্ষ করিলে অবিচার হইবে, কারণ নির্বাচনী ইস্তাহারমাত্রেই ইচ্ছাপত্র, যাহার দ্বারা রাজনৈতিক দল ভোটদাতার মন জয় করিতে চাহে। অর্থাৎ সকলেই যাহা করে, বিজেপিও তাহাই করিয়াছে, কেবল ইস্তাহারের নাম দিয়াছে সঙ্কল্প পত্র। আর ‘সোনার বাংলা’? তাহার অর্থ খুঁজিয়া লাভ নাই, কিন্তু সোনার বাংলা গড়িবার কেমন পরিকল্পনা সঙ্কল্প পত্রে পেশ করা হইয়াছে? কী তাহার বিশেষত্ব? কোথায় তাহা স্বতন্ত্র?

Advertisement

এই প্রশ্নের সত্য উত্তর: অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনও বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনাই ইস্তাহারে নাই। কেন পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের দীর্ঘ খরা কাটিবে, কোন ইন্দ্রজালে কর্মসংস্থানে জোয়ার আসিয়া প্রতিটি পরিবারে এক জন কাজ পাইবেন, তাহার কোনও সদুত্তরের আশা করিয়া যে লাভ নাই, তাহা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সংবাদপত্রকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার হইতেও স্পষ্ট। সঙ্কল্প পত্রটি উন্নয়নী পরিকল্পনার নামে বিতরণ করিয়াছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে রকমারি স্বীকৃতি, সুবিধা এবং অনুদানের সাড়ে বত্রিশ ভাজা। এবং সেইগুলি বহুলাংশে বিভিন্ন দল ও রাজ্যের নীতি টুকিয়া বাজিমাতের চেষ্টা। দৃষ্টান্ত: সরকারি পরিবহণে মেয়েদের নিখরচায় যাতায়াতের প্রতিশ্রুতি, যাহা অরবিন্দ কেজরীবালের অনুগমন। কিংবা দলিত ও আদিবাসী মেয়েদের শিক্ষায় অনুদান বা বিধবাদের পেনশন— মেয়েদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবিধ প্রকল্পের অনুসরণেই নহে কি? বস্তুত, যে অনুদান-নির্ভর পপুলিজ়ম বা জনবাদের সমালোচনায় সপারিষদ নরেন্দ্র মোদী মুখর, পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের দল সেই অনুদানকেই প্রাণপণ আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে। কৃষক, মৎস্যজীবী, উদ্বাস্তু, চা-বাগানের শ্রমিক, রাজনৈতিক হিংসায় নিহতের পরিবার— অনুদান-প্রাপকের তালিকা যেমন দীর্ঘ, তেমনই বিচিত্র। অন্য দিক দিয়া দেখিলে, মাহিষ্য, তিলি প্রমুখ বর্গের জন্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি রহিয়াছে মতুয়া দলপতিদের জন্য বিশেষ পেনশন। অর্থাৎ, সংরক্ষণ এবং জাতপাতভিত্তিক রাজনীতিই এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অবলম্বন! ‘মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে’ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করাইবার প্রস্তাব লওয়া হইবে— এই প্রতিশ্রুতিও স্পষ্টতই তাহারই অঙ্গ। ‘এনআরসি’-জনিত আতঙ্ক দূর করিয়া বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে আনিবার প্রয়াসটি নিতান্ত প্রকট।

ঠিক যেমন প্রকট হইয়া উঠিয়াছে ‘বাঙালির মন’ জয়ের নানা উদ্যোগ। ‘বহিরাগত’ তকমা এবং হিন্দির আগ্রাসনের অভিযোগ সামলাইবার তাড়নায় দশম শ্রেণি অবধি বাংলা আবশ্যিক করিবার প্রতিশ্রুতিটি নিতান্তই বাঙালিয়ানার ময়ূরপুচ্ছ। প্রতিটি ব্লকে নেতাজি বসু বিপিও তৈয়ারি হইবে, ভাবিলে সুভাষচন্দ্রের জন্য বেদনাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায়ের নামে ‘আন্তর্জাতিক’ পুরস্কারের প্রস্তাবটি যে কোনও সচেতন বাঙালিকে বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দিবে। প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণ লইয়া সস্তা কৌতুক পরিহার্য, কিন্তু বিজেপির বড় মেজো ছোট নেতানেত্রীর আচরণে বঙ্গসংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধা দূরস্থান, ন্যূনতম আগ্রহেরও প্রমাণ দুর্লভ। সেই কারণেই ময়ূরপুচ্ছ আরও বেশি দৃষ্টিকটু। ইস্তাহারের গরু মঙ্গলগ্রহে উঠিতেই পারে, কিন্তু বিজেপির মহানায়করা সোনার বাংলা গড়িবার সঙ্কল্প পত্র রচনা করিতে বসিয়া একটি গোড়ার কথা স্মরণে রাখেন নাই। যাহা কিছু চকচক করে তাহাই সোনা নহে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement