ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা একটি কঠোর সত্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন দেশবাসীকে— সংবিধান যা-ই বলুক, দেশের উচ্চ আদালতগুলি সংবিধানের সেই সত্য রক্ষায় যত গুরুত্বই দিক, রাজনৈতিক শাসকদের যদি সংবিধানের প্রতি আনুগত্য, সম্ভ্রম এবং নিষ্ঠা না থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত সেই আদর্শগুলি কিছু মুদ্রিত শব্দমাত্র। সংবিধানের অবমাননায় নাগরিক সমাজ ব্যথিত হতে পারে, মোমবাতি হাতে মিছিল করতে পারে, অনশনে বসতে পারে— কিন্তু, যে শাসকের গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠা নেই, দেশের মৌলিক তন্তুগুলিকে রক্ষা করার তাগিদ নেই, সেই শাসকের মন পাল্টাতে পারে না। বর্তমান ভারতে বহু প্রসঙ্গেই কথাগুলি সমান ভাবে প্রযোজ্য, তবে আপাতত আলোচ্য অসমের গোয়ালপাড়া জেলায় এক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার গ্রেফতার হওয়ার সংবাদটি। তাঁর ‘অপরাধ’, তিনি স্কুলে গোমাংস এনেছিলেন। গোমাংস ভক্ষণ বিষয়ে ভারতের সংবিধান কী বলে, দেশের বিভিন্ন আদালত বারে বারে ব্যক্তিগত পছন্দ অনুসারে খাদ্যগ্রহণের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে কোন কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, সেই সব কথা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের যেমন জানা, ক্ষমতাসীন গৈরিক বাহিনীরও তেমনই জানা। কিন্তু, মহম্মদ আখলাককে হত্যা করা দিয়ে গোমাংসকে কেন্দ্র করে যে হিংস্রতার স্রোত বইতে আরম্ভ করেছে, সংবিধানের শব্দের সাধ্য কী তাকে প্রতিহত করার! কখনও ব্যক্তির হিংস্রতা, আবার কখনও রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা— ‘অপর’-কে দমন করার দ্বিমুখী অস্ত্র ব্যবহারে হিন্দুত্ববাদী শক্তির সামনে সংবিধানের আদর্শ কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ ভূষণ লজ্জা। দেশের জনগণের সম্মুখে, বৃহত্তর বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের অনৈতিক আচরণ ধরা পড়ে গেলে শাসক যদি লজ্জিত হয়, একমাত্র সেই লজ্জাটুকুই ভরসা। নির্বাচনী গণতন্ত্রে মানুষের কথা মাথায় রাখার বাধ্যবাধকতা শাসকের থাকেই। কিন্তু, এই লজ্জার উৎস সেই বাধ্যবাধকতা নয়। এত দিনে বহু নির্বাচনে এ কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, সংখ্যালঘু বা তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি অসমদর্শী হলেও, নারীর নিরাপত্তা বজায় রাখতে না পারলেও, এমনকি নিরন্তর মিথ্যা কথা বললেও ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব। বর্তমান অভিজ্ঞতা বলবে, তার জন্য কিছু কৃত্রিম বিভাজনরেখা সৃষ্টি করে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে অহেতুক ভীতির আবহ সৃষ্টি করে বিদ্বেষের রাজনীতিকে পুষ্ট রাখাই যথেষ্ট। কিন্তু, শাসক যদি প্রকৃত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হন, তবে তাঁর এই পথে হাঁটতে লজ্জাবোধ হবে। তিনি জানবেন, যে দায়িত্ব পালনের ভার সংবিধান তাঁর হাতে ন্যস্ত করেছিল, তিনি তাতে শুধু ব্যর্থই হননি, তার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। এই লজ্জার বোধটি আসে অন্তরের নৈতিকতার বোধ থেকে। ভারতের দুর্ভাগ্য, বর্তমান শাসকদের মধ্যে এই নৈতিকতার বোধ কার্যত নেই। আশঙ্কা হয়, সংবিধানকে তাঁরা ভারতের আত্মা হিসাবে গ্রহণ করেননি— বরং, সদ্য স্বাধীন দেশে উদারবাদী রাজনৈতিক যুগপুরুষরা যে গৈরিক সঙ্কীর্ণতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এক নতুন ভারত রচনা করতে চেয়েছিলেন, বর্তমান শাসকরা সংবিধানকে সম্ভবত গৈরিক রাজনীতির সেই পরাজয়ের প্রতীক হিসাবে দেখেন। ফলে, সেই সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা, তার আদর্শ থেকে চ্যুত হওয়ার লজ্জা, কোনওটিই তাঁদের নেই। তাঁদের দাপটের সামনে বহুত্ববাদী ভারতের আদর্শটি অসহায়।