এক-একটি ৩০ জানুয়ারি আসে, মহাত্মা গান্ধীর প্রয়াণবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁহাকে স্মরণ করিয়া থাকেন। যুক্তকরে শ্রদ্ধা নিবেদন, ভাষণ বা টুইটে ‘বাপু’র আদর্শের প্রচার-প্রসারের আহ্বান— সমস্তই করেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাবরমতী নদীতীরে অভিনব প্রযুক্তি-চরকা ঘুরাইয়া মহাত্মার মুখাবয়ব-সমন্বিত দেওয়ালচিত্র উদ্বোধন করিলেন। শাসককে এই সবই করিতে হয়, অন্তত দেশবাসী ও প্রচারমাধ্যমের সামনে— মনের ভিতরে আর যাহা কিছুই থাকুক না কেন। ‘আর যাহা কিছু’ও অবশ্য ঘটা করিয়াই হয়, যেমন গোয়ালিয়রে হিন্দু মহাসভার নাথুরাম গডসে ও নারায়ণ আপ্তে ‘স্মৃতি দিবস’ পালন, গান্ধীর নামে অপমানজনক মন্তব্যকারী উগ্র হিন্দুত্ববাদীকে ‘গডসে-আপ্তে ভারতরত্ন’ ভূষণে বরণ ইত্যাদি। এই ৩০ জানুয়ারিতেই।
সমান্তরাল দুই ‘উদ্যাপন’-এর অন্তর্গত বার্তাটি স্পষ্ট: এই শ্রদ্ধা নিতান্তই লোক-দেখানো, হিন্দুত্ববাদীদের নিরন্তর গান্ধী-অপমানই বিজেপির প্রার্থিত, তাহা না হইলে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ চুপ থাকিবেন কেন। হিন্দুত্ববাদের সহিত গান্ধীর সর্বজনীনতার আদর্শের বনিবনা নাই জানা কথা, কিন্তু গান্ধী-বিরোধিতা ও গডসে-ভজনার একরৈখিক বৈপরীত্যের ঊর্ধ্বে উঠিলেই প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখিতে পাইতেন, গডসে এক জন অপরাধী, হত্যাকারী— কেবল গান্ধী-ভক্তদের চোখে নহে, ভারতরাষ্ট্রের বিচারে। রাষ্ট্রীয় আইনমতে, বিচারপ্রক্রিয়া শেষে যে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইয়াছিল, তাহাকে লইয়া মাতামাতি কী করিয়া আজিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শাসক অনুমোদন করিতে পারে? এক হত্যাকারীর চূড়ান্ত অপরাধের উদ্যাপনও যখন মহা সমারোহে হয়, তখন বুঝিতে ভুল হয় না, শাসক দলের কেবল গান্ধী-অবমাননায় সম্মতিই নহে, অবমাননাকারীদের পাশে থাকিবার সার্বিক সমর্থন ও সহযোগও রহিয়াছে।
গডসের বেলাগাম বন্দনা, প্রায়শই গান্ধীর মূর্তি ভাঙা, প্রজাতন্ত্র দিবসের ‘বিটিং রিট্রিট’ হইতে গান্ধীর পছন্দের প্রার্থনাকে সরাইয়া দেওয়া, আবার তাহার পাশাপাশি ৩০ জানুয়ারি রাজঘাটে শ্রদ্ধা নিবেদন, সাবরমতীর দেওয়ালচিত্র উদ্বোধন— ঘটনাগুলির সমান্তরাল সংঘটনই প্রমাণ, সমগ্র ব্যাপারটির মধ্যে বিরাট এক রাজনৈতিক দ্বিচারিতা বর্তমান। মহাত্মা গান্ধীকে লইয়া সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রে শাসক দলের এই ভণ্ডামির ছকটি কেবল রাজনীতির মনোযোগী পর্যবেক্ষকদের কাছেই নহে, জনসাধারণের চোখেও পরিষ্কার হইতেছে: দিবসবিশেষে মহাত্মাকে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা দেখাইব, তাহা ব্যতীত কিংবা তাহার পাশাপাশিই অপমানও করিব, তাহাও রীতিমতো অনুষ্ঠান করিয়াই। জওহরলাল নেহরুকে লইয়া সমস্যা নাই, বিজেপি তাঁহাকে আগাগোড়াই সমালোচনার কাঠগড়ায় তুলিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রভাবনার কাছে মহাত্মার আদর্শ দুরূহ, অধরাও— অথচ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর পরেও ভারতজীবনে গান্ধীর প্রভাব পরিব্যাপ্ত। এই সহজ সত্যের সামনে দাঁড়াইতে পারার, বা তাহা মানিবার সামর্থ্য নাই বলিয়াই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ ও তাঁহাদের দল গান্ধীর প্রতি যুগপৎ শ্রদ্ধা ও অপমানে সতত দোদুল্যমান। অন্তর হইতে যে বিশ্বাস আসে না, বহিরঙ্গে তাহার প্রদর্শনে কতই না বেগ পাইতে হয়। রাজনীতি বড় গরজ।