মাছের সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির সম্পর্কটি অন্তরের। ঈশ্বর গুপ্ত একদা লিখেছিলেন, “ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল, ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।” মাছ বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় জীবনের অঙ্গও বটে। বহু পুজোতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে মাছের উপস্থিতিকে শুভ মনে করা হয়। তাই ধর্মের অজুহাতে বাঙালির মাছ খাওয়ার অভ্যাসটিতে আঘাত হানার চেষ্টা আসলে বাঙালির আত্মপরিচিতির উপরে আক্রমণ। সম্প্রতি দিল্লিতে গেরুয়াবাহিনীর কিছু সদস্য যে মাছের বাজার নিয়ে আপত্তি তুলেছেন, শহরের ‘বাঙালিটোলা’ বলে চিহ্নিত চিত্তরঞ্জন পার্কের সেই মাছের বাজারটিতে দিল্লির বিভিন্ন কোণ থেকে বাঙালিরা মাছের খোঁজে আসেন। আপত্তির কারণ, বাজার লাগোয়া একটি কালীমন্দির। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীদের অর্থেই মন্দিরটি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সনাতনীদের বুদ্ধিমতে, মেছো স্পর্শে মন্দিরের পবিত্রতা বিপন্ন হয়েছে। অতএব রাতারাতি বাজার বন্ধের ফরমান।
স্বঘোষিত ‘সনাতনী’দের ভারত সম্পর্কে পড়াশোনার গণ্ডি যদি কিঞ্চিৎ বিস্তৃত হত, তবে জানতে পারতেন, ভারতের ঐতিহ্যটি কোনও দিনই নিরামিষতন্ত্র দ্বারা চালিত হয়নি। বরং এই সুবিশাল, বৈচিত্রপূর্ণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খাদ্যাভ্যাসে স্থানীয় পরিবেশ, জীবনযাপনের রীতি প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। এখনও এ দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ আমিষাশী। এবং তার ভিতরেও স্থানীয় পছন্দ, রন্ধনপ্রণালী প্রভৃতি অনুসারে বহু ক্ষুদ্র ভাগ বর্তমান। বোধবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের কর্তব্য সেই বিভিন্নতা-র প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাকে অক্ষুণ্ণ রাখা। কারণ, খাওয়ার বিষয়ে স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক অধিকারও বটে। তদুপরি, বাঙালির আরাধ্যা কালী আসলে বাঙালির ঘরের মেয়ে। কালীপুজোর নিয়মগুলিতে নানা পথের, নানা মতের সংমিশ্রণ ঘটেছে, নিরামিষ ভোগের পাশাপাশি আমিষ ভোগও সমান গুরুত্ব পেয়েছে। সুতরাং, মাছের বাজারের স্পর্শে মন্দিরের শুদ্ধতা নষ্টের ধারণা একান্ত ভাবেই ‘নাগপুর’-এর মস্তিষ্কপ্রসূত, যাঁরা কোনও দিনই ভিন্নতাকে সম্মান জানাতে শেখেননি।
দিল্লির ঘটনায় যতই বিজেপি নেতারা বিতর্ক ঠেকাতে আসরে নামুন, এই কাণ্ড আসলে তাঁদের এক দেশ-এক ধর্ম-এক ভাষা এবং এক খাদ্যাভ্যাস কর্মসূচির পরিবর্ধিত সংস্করণ। দিল্লিতে সদ্য বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অন্য বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে যে ভঙ্গিতে প্রকাশ্যে মাংস বিক্রয় এবং আমিষ ভক্ষণ নিষিদ্ধ হয়েছে, গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধ’-এ সংখ্যালঘুদের উপর একাধিক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু ক্রমাগত এই ‘এক’-এর আরাধনা একটি বৈচিত্রপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের নিয়ম হতে পারে না। নবরাত্রির সময় উত্তর ভারতের এক বড় অংশের হিন্দুরা আমিষ ভক্ষণ করেন না, এ কথা সত্য। কিন্তু এটাও সমান সত্য, পূর্ব ভারতের ঘোর আমিষাশী হিন্দু বাঙালি সেই নিয়মের সঙ্গে নিজেদের বাঁধেননি, তাই তাঁরা দুর্গাপুজো থেকে দোল উৎসব— আমিষ পদেই রসনাতৃপ্তি করেন। এই বৈচিত্রকে অসম্মান করা সংবিধানপ্রদত্ত জীবন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ। দিল্লির ‘সনাতনী’ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি— কেউই যে কথাটি মনে রাখতে চাইছেন না, সেটাই উদ্বেগের।