রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের রাগ দেখলে রবীন্দ্রনাথ মজা পেতেন। তিনি যখন লিখেছিলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’, তখন সেই মাটি কঠিন না কোমল, তা তিনি ভাবেননি, ভাবার দরকারও হয়নি তাঁর। তিনি তো আর ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা-মন্ত্রীদের দেখে যাননি, তাই জানতেন না যে দেশপ্রেমের জন্য ‘সয়েল টেস্টিং’-এর দরকার হয়। শ্রীবৈষ্ণব সংসদে দাঁড়িয়ে প্রবল বিক্রমে আপন দেশপ্রেম জাহির করেছেন। রেল বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও কোনও প্রতিনিধি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ভারতের মাটি বুলেট ট্রেন চলার উপযোগী কি না। প্রশ্নটি তত্ত্বের নয়, তথ্যের। রেললাইন পাততে হলে জমি পরীক্ষা করে নিতে হয়, সেটা কোনও গোপন খবর নয়। যে ট্রেন অস্বাভাবিক জোরে দৌড়বে, তার জন্য মাটিও জোরদার হওয়া চাই বইকি। নিজের জোর না থাকলে বাইরে থেকে জোর বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে, প্রযুক্তিবিদরা সে-সব কারিগরি জানেন। সুতরাং সংসদীয় প্রশ্নটার সহজ উত্তর দেওয়া যেত, প্রশ্নকর্তাকে আশ্বস্ত করা যেত যে, যা যা দরকার সব ব্যবস্থাই করা হবে, মাটির শক্তি যাচাই না করে বুলেট ট্রেন চালানো হবে কেন?
মাটির জোর নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্নটাতে যে ভয়ানক বুদ্ধির ছাপ আছে, এমন কথা বলা শক্ত, তাই রেলমন্ত্রী সহজেই সেটিকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে পারতেন, হয়তো সংসদে কিছু রঙ্গকৌতুকের সুবাতাস বইয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ক্রোধ অতি বিষম বস্তু। রাগ হলে মানুষের মনে সবার আগে যে অনুভূতিটি নষ্ট হয়ে যায়, তার নাম কৌতুকবোধ। অতএব প্রশ্ন শুনে শ্রীবৈষ্ণব মজা পাননি, হাসেননি, রেগে আগুন হয়েছেন। প্রায় হাত-পা ছুড়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন: দেশের মাটির উপর বিরোধীদের বিশ্বাস নেই? তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগানটির কথা টেনে আনতেও তাঁর ভুল হয়নি— মন্ত্রিবর ধিক্কার দিয়ে বলেছেন: যাঁরা ‘মা মাটি মানুষ’-এর জয়গান করেন তাঁদের মুখে এ কী কথা শুনি আজ! তৃণমূলের সাংসদরা এমন আক্রমণ শুনে কী ভেবেছেন জানা নেই, তবে রেলমন্ত্রী নিশ্চয়ই মনে মনে পুলকিত যে, মুখের মতো একখানা জবাব শুনিয়ে দেওয়া গেছে— নরম মাটি ভেবে আঁচড়াতে এসেছিল, বুঝিয়ে দিয়েছি এ বড় কঠিন ঠাঁই!
কিন্তু এত রাগ কোথা থেকে আসে? সন্দেহ হয় যে, রেলমন্ত্রীর নিজের দেশপ্রেমের প্রমাণ দেওয়ার বিশেষ দায় আছে। হয়তো এই চিৎকৃত দেশপ্রেমের উপরেই তাঁর পদোন্নতি নির্ভর করবে, বড়কর্তাদের নেকনজরে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। সেই কারণেই ‘দেশের মাটির অপমানে’ এমন জাতীয়তাবাদী ধুন্ধুমার। ভেবে দেখলে, এখানেই মোদী জমানার এবং সেই জমানার নিয়ামক সঙ্ঘ পরিবারের বিশেষত্ব। তাঁদের জাতীয়তাবাদের বিশেষত্ব। সেই জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে মস্ত ভুল হবে। আশিস নন্দীর মতো সমাজবিজ্ঞানীরা দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের পার্থক্য নিয়ে যে মূল্যবান বিশ্লেষণ করেছেন, সে-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র অভিরুচিও সঙ্ঘ পরিবারের থাকবার কথা নয়। স্বভাবত উগ্র, সর্বদা ‘যুদ্ধং দেহি’ ঘোষণায় ব্যগ্র তাঁদের নাগপুরে প্রস্তুত জাতীয়তা কখনও তার স্বদেশকে প্রেমের পাত্র বলে মনে করে না; সেই জাতীয়তার কারবারিরা কখনও তাকে ডেকে বলেন না, ‘আমি তোমায় ভালবাসি’, বলবার কথা ভাবতেও পারেন না। তাই বোধ করি রেলমন্ত্রীর এত রাগ, এত লম্ফঝম্প। রবীন্দ্রনাথ জানতেন উগ্র জাতীয়তাবাদ কী ভাবে দেশপ্রেমকে গ্রাস করে তাকে বিকৃত ও ভয়ঙ্কর রূপ দেয়। তবে জাতীয়তাবাদী দেশের বজ্রকঠিন মাটিতে মাথা ঠেকাতে গেলে মাথা ফেটে যেতে পারে, এত দূর অবশ্য তিনি ভেবে উঠতে পারেননি।