এক দশক আগে যখন নির্বাচনজয়ের লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদী অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছিলেন, তখন থেকে তাঁর অথবা অমিত শাহের মুখে একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের উল্লেখ শোনা যায়নি কখনও— ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গা, মতান্তরে গণহত্যা। অথচ প্রাক্-২০১৪ ভারতে এই ঘটনাটির জন্যই মোদী সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন দেশে এবং বিদেশে। এত দিনে শোনা গেল সেই ঘটনার কথা, তাঁদের নিজমুখে। গুজরাতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে অমিত শাহ জানালেন, ২০০২ সালে রাজ্যে ‘পাকাপাকি শান্তি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা দাঙ্গা করত, তাদের এমন শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যে, তারা আর কখনও কোনও অশান্তি সৃষ্টি করার সাহস পায়নি। অমিত শাহের বাচনভঙ্গি ঈর্ষণীয়— কে ‘শিক্ষা’ দিয়েছিল, কোন জনগোষ্ঠীকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছিল, ভবিষ্যতেও সেই ‘শিক্ষা’র ব্যবস্থা করা হবে কি না, তার কোনওটিই তিনি স্পষ্ট করে বললেন না, অথচ যা বোঝার, বোঝানো হয়ে গেল দ্ব্যর্থহীন ভাবে। প্রশ্ন হল, ২০০২ সাল থেকে যে প্রসঙ্গ ওঠামাত্র নরেন্দ্র মোদী দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়তেন, ভরা জনসভায় দাঁড়িয়ে সেই প্রসঙ্গেই অমিত শাহ এমন রাখঢাকহীন মন্তব্য করলেন কেন? কুড়ি বছরে ঘটনাটির অভিঘাত হ্রাস পেয়েছে বলে? রাজ্যের সংখ্যালঘুরা ক্রমশই নিজেদের ললাটলিখন মেনে নিচ্ছেন বলে? না কি, গত আট ন’বছরে ভারত নামক দেশটি এমন ভাবে পাল্টে গিয়েছে যে, সেখানে দাঁড়িয়ে শতাব্দীর অন্যতম লজ্জাজনক ঘটনার কথাও বুক ফুলিয়ে বলা যায়?
তিনটি কারণই সত্য— তার মধ্যে তৃতীয়টি ভয়ঙ্কর রকম সত্য, এবং সেই সত্য গুজরাতের প্রায় দু’লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন নিজের জন্য যেমন রাষ্ট্র নির্মাণ করে নিতে চায়, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকরা ভারতকে তেমন রাষ্ট্রে পরিণত করতে ইতিমধ্যেই বহু দূর অবধি সফল। কর্তৃত্ববাদী শাসনে ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের সত্তা এক ও অভিন্ন— এনআরসি-সিএএ’র সঙ্গে ২০০২ সালের দাওয়াইয়ের চরিত্রগত প্রভেদ নেই, উভয় অস্ত্রই একই ভাবে প্রযোজ্য। যে কোনও কর্তৃত্ববাদী শাসকেরই ঘোষিত শত্রু থাকে, বিজেপিরও রয়েছে— এবং, সেই শত্রুকে যে কোনও ভাবে দমন করাই যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য, এই কথাটি ভারতে প্রতিষ্ঠা করতে বহুলাংশে সফল ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার। প্রাক-মোদী ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছিল না, তা নয়, কিন্তু তা সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভারতে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, এমনকি বহুলাংশে গৌরবান্বিতও হয়েছে। এবং এই প্রবল অ-স্বাভাবিকতাকে বৃহত্তর জনসমাজ ‘স্বাভাবিক’ বলে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। ধর্ম বা অন্য কোনও পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনও গণহত্যা সমর্থন করা চলে না, বৃহত্তর সমাজ এই কথাটি আর ভাবতে পারে না বলেই প্রকাশ্য জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথাগুলি বলার সাহস পেয়েছেন।
এই ঘোষণা বলে দেয় যে, তাঁরা জানেন, ভারতের ধারণাটিকে তাঁরা মূলগত ভাবে পাল্টে দিতে সফল হয়েছেন, এবং তাঁরা চান যে, সমস্ত ভারতবাসীও তা জানুন। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র শুধু অস্বাভাবিকতার পক্ষে জনসম্মতি নির্মাণের মাধ্যমেই চলে না— প্রতিষ্ঠানও ক্রমেই সেই অস্বাভাবিকতাকে মান্যতা দিতে থাকে। লক্ষণীয়, অমিত শাহের মন্তব্যটি নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখনও উচ্চবাচ্য করেনি। অন্য দিকে, কেউ স্মরণ করতে পারেন যে, গত জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত দাঙ্গায় মোদীকে বিশেষ তদন্তকারী দলের ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করতে অস্বীকার করেছে; অক্টোবরে গুজরাত সরকার বিলকিস বানো মামলার অপরাধীদের মুক্তি দিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তকে ‘ক্ষমা পরম ধর্ম’ বলে সমর্থন করেছেন রাজনৈতিক নেতারা, ভোটের বাজারেই। সব মিলিয়ে কর্তৃত্ববাদের পদধ্বনি নিকটতর হচ্ছে প্রতি দিন।