ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় সরকার লখিন্দরের লৌহবাসর রচনা করিতে বদ্ধপরিকর— শিক্ষার ফাঁক গলিয়া যাহাতে সচেতনতা কোনও ক্রমে তাহাদের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের একমাত্রিক নাগপুর-কল্পনার পরিসরে ঢুকিয়া পড়িতে না পারে। সরকার এক দিকে গবেষণার প্রসার এবং মানোন্নয়নের বরাদ্দ ছাঁটিতেছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি এবং কারিগরি বিদ্যার গবেষণায় গত বৎসরের তুলনায় বরাদ্দ কমাইয়াছে ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট। তদুপরি, গত বৎসর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ নির্মাণ করিবার কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন, যাহাতে গবেষণায় বাড়তি অর্থ বরাদ্দের আশা মিলিয়াছিল। কিন্তু এখনও অবধি প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় নাই। অতএব টাকা বরাদ্দও হয় নাই। অপর দিকে, সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক ঘোষণা করিয়াছে যে, সরকারি স্কলারশিপ লইয়া বিদেশে পড়িতে গেলে নির্দিষ্ট কয়েকটি পাঠ্যবিষয়কে পরিহার করিতে হইবে গবেষকদের। ‘নিষিদ্ধ’ তালিকায় রহিয়াছে ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সমাজতত্ত্ব। তাহাতে শোরগোল পড়িলে মন্ত্রক ব্যাখ্যা করিয়াছে, ভারতীয় ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতির গবেষণা ভারতের উচ্চমানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে করিলেই হয়, ভারতীয় অধ্যাপকরা সে সকল বিষয়ে অধিক জানেন। অতএব বিদেশে ওইগুলি পড়িবার প্রয়োজন নাই।
নাগপুরের সহিত উচ্চশিক্ষার যে মুখ-দেখাদেখি নাই, তাহা জানা কথা। কিন্তু তাহার পরও এ-হেন যুক্তিক্রমে স্তম্ভিত হইতে হয়। কেবল বিদেশে অবস্থিত বলিয়াই অক্সফোর্ড অথবা হার্ভার্ড ভারতীয় সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্বের পঠন-পাঠনে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পিছাইয়া থাকিবে, বলিতে তুমুল অশিক্ষা, অথবা তুমুলতর দুরভিসন্ধি থাকা প্রয়োজন। ভারতীয় গবেষকরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে গবেষণা করিবেন, সরকার কোন অধিকারে তাহাই বা স্থির করিয়া দিতে চাহে? সকল দেশেই সরকার মেধাবী ছাত্রদের স্কলারশিপ দিয়া থাকে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীর বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতায় কেহ সহসা হস্তক্ষেপ করে না।
এ-হেন অকারণ খবরদারি তবে কেন? অভিযোগ উঠিয়াছে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের বর্ণব্যবস্থার সমালোচনামূলক চর্চা কেন্দ্রের অপছন্দ, তাই গবেষণাকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ‘নিরাপদ’ খাতে বহাইবার চেষ্টা। ইহা নেহাতই অশিক্ষিতের ন্যায় আচরণ— ঘরের অন্ধকারে সমস্যা নাই, সেখানে বাহিরের আলো আসিয়া পড়িলেই ‘গেল, গেল’ রব। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য সমাজে আপন অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা, আপন গোষ্ঠী এবং সমাজের উত্তরণের চেষ্টা। বিদেশের প্রতিষ্ঠানে হওয়া গবেষণায় সেই সুযোগ মিলিলে সরকার দরজা বন্ধ করিয়া দিবে কেন? সরকার আপন কাজে মনোনিবেশ করিতে পারে। প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় চিনে গবেষকের সংখ্যা শতাধিক, ভারতে মাত্র পনেরো। বিশ্বসেরা গবেষণা পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যায় আমেরিকা অথবা চিনের গবেষকদের তুলনায় বহু পিছাইয়া ভারতীয় গবেষকরা। ভারত তাহার জিডিপির এক শতাংশও গবেষণায় বরাদ্দ করে নাই। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কোন বিষয়ের শিক্ষকতায় অনুপযোগী, তাহার বিচার করিয়া সরকার কালক্ষেপ না করিলেই ভাল।