আর জি কর ধর্ষণ-হত্যা কাণ্ডে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে যে আশঙ্কা জন্মেছিল, তা আরও গভীর হয়েছে নানা জেলায় পর পর কয়েকটি হিংসার কাণ্ডে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এক নয় বছরের বালিকার ধর্ষণ-হত্যা, পূর্ব মেদিনীপুরে এক বধূর ধর্ষণ-হত্যা, নদিয়ায় এক দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীর দগ্ধ দেহ উদ্ধার, প্রতিটি ঘটনাই স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ তৈরি করেছে। ক্ষোভের লক্ষ্য যেমন হিংসায় অভিযুক্তরা, তেমনই পুলিশও। বিশেষত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘটনাটিতে কর্তব্যে গাফিলতি এবং অসংবেদনশীলতার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অন্যত্রও নারীহিংসার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিতে নানা ভাবে পুলিশের প্রতি সন্দেহ ও অনাস্থার প্রকাশ দেখা গিয়েছে। এ হয়তো অপ্রত্যাশিত নয়। পুলিশের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক কখনওই খুব মজবুত ছিল না। তার উপর আর জি কর কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে ব্যাপক চর্চা চলেছে। ধর্ষণ-হত্যার প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, নিহত চিকিৎসককে দাহ করায় অতি-তৎপরতা, লালবাজার থেকে ঘটনাস্থলের ‘ক্রপ’ করা ছবি প্রকাশ, ১৪ অগস্ট রাতে হাসপাতালে দুষ্কৃতীদের প্রবেশ রুখতে পুলিশি ব্যর্থতা, নাগরিক প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীদের পুলিশি হয়রানি, এমন নানা ঘটনা পুলিশের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ফলে এখন পুলিশের কার্যকলাপের প্রতি অনেক সজাগ দৃষ্টি রাখছে নাগরিক সমাজ।
প্রভাবশালীদের বাঁচাতে অতি-সক্রিয়তা, নাগরিকের বিপন্নতায় নিষ্ক্রিয়তা— পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। বিশেষত নারীহিংসা, শিশুহিংসার মামলায় পুলিশের ভূমিকা বহু সমালোচিত। নিখোঁজ শিশু বা মহিলাদের পরিবার থানায় গেলে তাদের আকুতিকে উপেক্ষা, তাচ্ছিল্য করার পুলিশি অভ্যাস দুর্ভাগ্যজনক। ধর্ষণের অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করা, কথা বলে মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া, এই ধরনের বিধিলঙ্ঘনও থামেনি। পুলিশ অপরাধীকে ধরবে না, বা ধরলেও তদন্ত হবে না, এই ধারণা থেকেই অভিযুক্তকে ‘শিক্ষা দেওয়া’র প্রবণতা তৈরি হয় স্থানীয় মানুষের মধ্যে। বহু ক্ষেত্রেই তার ফল হয় আরও বড় অন্যায়। পূর্ব মেদিনীপুরে ধর্ষণ-অভিযুক্তকে গণপ্রহার তারই দৃষ্টান্ত। আর জি কর কাণ্ডে পুলিশের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির ফলে জনমানসে যে উষ্মা তৈরি হয়েছে, তাতে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুকে পুলিশ ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করলেই পুলিশের উপরে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। পুলিশ আদৌ নাগরিকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত, না কি তাকে আড়াল থেকে কেবলই নিয়ন্ত্রণ করছেন কোনও ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রী, সেই সন্দেহ নাগরিকদের বিপন্ন, বিচলিত করছে। কথায় কথায় তাই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার শরণাপন্ন হতে চাইছেন নাগরিক।
পুলিশি ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে সরকার-নিয়োজিত বিভিন্ন কমিটি নানা সময়ে যে সব সংস্কারের সুপারিশ করেছে, তার অধিকাংশই উপেক্ষা করেছে সংসদ, এবং বিভিন্ন দলের সরকার। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পুলিশ বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর দুর্বলতা। যথেষ্ট পুলিশকর্মীর অভাব তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে অপরাধী দ্রুত চিহ্নিত করার আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের অভাব। পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত ও সাক্ষ্য সংগ্রহের ব্যবস্থায় প্রচুর ফাঁক রয়ে গিয়েছে। প্রশাসনিক স্তরে পুলিশকে কাজে লাগানোর নকশা ভারসাম্যহীন, ভারতে এক জন ‘ভিআইপি’-পিছু তিন জন পুলিশ, যেখানে ৬৬৩ জন নাগরিক-পিছু এক জন পুলিশ। এর ফলে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত, সাক্ষ্য সংগ্রহের মতো কাজগুলি উপেক্ষিত হয়। পুলিশের সততার প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখার সঙ্গে, পুলিশি ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও সক্রিয় করার উপায় নিয়েও ভাবা চাই। শুধুমাত্র অনাস্থা প্রকাশ করে শেষ বিচারে আইনের শাসনকে দুর্বলতর না করে যথাযথ সচেতনতা তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি তোলাও নাগরিক সমাজের কর্তব্য।