Coromandel Express accident

লাঞ্ছিত শোক

গোড়ার কথাতেই ফিরে যাওয়া জরুরি। রাজনীতি আসলে বিস্মৃত হয়েছে যে, কোন পরিস্থিতিতে কোন কথা বলতে নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩ ০৮:০০
Share:

মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনা। — ফাইল চিত্র।

আর কিছু না হোক, খানিক সম্ভ্রম প্রত্যাশা করতে পারে শোকের মুহূর্তগুলি। আশা করতে পারে, প্রাত্যহিক তুচ্ছতাগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে দু’দণ্ড মৌনী হয়ে দাঁড়াবে সমাজ— যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, তার কথা ভাববে। ট্রেন-দুর্ঘটনায় প্রায় তিনশো মানুষের মৃত্যু ছিল তেমনই এক শোকের মুহূর্ত। হায়! রাজনীতির ঘোলাজল ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকেও। আইটি সেল-এর কাছে মূল্যবোধ বা নৈতিকতা প্রত্যাশা করা অর্থহীন, সে কথা হাড়ে হাড়ে জেনেও স্তম্ভিত হতে হয়, যখন তারা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার গায়েও লেপতে চায় বিদ্বেষের রং— এবং, আরও মারাত্মক, যখন ‘রাজনীতির বাইরে থাকা’ সাধারণ মানুষ নির্দ্বিধায় সেই বিষ ছড়িয়ে দিতে থাকেন নিজের মোবাইল ফোন থেকে পরিচিত-অপরিচিতদের মোবাইলে। অবশ্য, কয়েক মাসের রেলমন্ত্রী, অধুনা শাসক দলের জনৈক নেতা যে ভঙ্গিতে জানিয়ে দেন যে, এই দুর্ঘটনার পিছনে নিশ্চিত ভাবেই ‘চক্রান্ত’ রয়েছে, এবং উচ্চারণ না করে যে ইঙ্গিত দেন, তাতে আইটি সেলের ভাড়াটে পদাতিক বা অন্তরে বিদ্বেষ পুষে রাখা সাধারণ্যের দিকে আলাদা করে আঙুল তোলার আর অর্থ থাকে না। পাশাপাশিই চলছে রাজনৈতিক তরজা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভঙ্গিতে ‘মৃতদেহ লুকিয়ে রাখা’র অভিযোগ পেশ করেছেন, অথবা ক্ষমতাসীন বিজেপি যে ভাবে পূর্ববর্তী জমানার রেলমন্ত্রীদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে উদ্‌গ্রীব, তার কোনওটিই এই শোকের মুহূর্তে মানানসই নয়। রাজনীতি বুঝি মানবিকতার প্রাথমিক শর্তগুলিকেও গলা টিপে হত্যা করে! অবশ্য, ভারতীয় রাজনীতিতে মৃতদেহ সব সময়ই এক অমোঘ অস্ত্র। ফলে, এতগুলি মানুষের মৃত্যুকে যে প্রতিটি দলই রাজনৈতিক লাভের স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইবে, সে কথায় এখন আর আশ্চর্য হওয়ারও উপায় নেই। বিরোধী নেতানেত্রীরাও এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির সুযোগ খুঁজছেন, এবং খুঁজবেন— সন্দেহ কী!

Advertisement

এই দুর্ঘটনার তদন্তভার কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী সিবিআই-এর হাতে তুলে দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তটিও বিস্ময় জাগাতে বাধ্য। বিরোধীরা যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন যে, সিবিআই তো অপরাধের তদন্ত করে। তারা তো রেল-বিশেষজ্ঞ নয়, রেলের কোনও পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ তদন্ত ব্যতিরেকেই রেলমন্ত্রী নিশ্চিত হলেন কী করে যে, এই দুর্ঘটনার পিছনে কোনও অপরাধ রয়েছে? তা হলে কি এই সিবিআই তদন্ত আসলে দুর্ঘটনার দায় অন্য কারও উপরে চাপানোর কৌশল? আইটি সেল-এর কার্যকলাপ দেখে কারও এই সন্দেহ হলে দোষ দেওয়া মুশকিল। বিশেষত, এই জমানায় সিবিআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অপব্যবহারের উদাহরণ এতই সুলভ যে, ভয় হয়। ভারতীয় রাজনীতি আজ যে পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থেই অতল। নামার কোনও শেষ নেই। ফলে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যা নিতান্ত অভাবনীয়, আজকের রাজনীতি এই শোকের আবহে তা ভাবতে পারে তো বটেই, সেই ভাবনাকে কাজে রূপায়িতও করতে পারে বলেই আশঙ্কা হয়।

গোড়ার কথাতেই ফিরে যাওয়া জরুরি। রাজনীতি আসলে বিস্মৃত হয়েছে যে, কোন পরিস্থিতিতে কোন কথা বলতে নেই। দক্ষিণ ভারতমুখী, এবং দক্ষিণ ভারত থেকে আগত দুর্ঘটনাগ্রস্ত উভয় ট্রেনেই বাঙালির সংখ্যা ছিল প্রচুর। তাঁদের মধ্যে অনেকে হয়তো পরিযায়ী শ্রমিকও ছিলেন। এই রাজ্য থেকে অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকদের ভিনরাজ্যে রুজির খোঁজে যাওয়া নিতান্ত বাস্তব। পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট কাজ নেই বলেই তাঁরা বাইরে যান, সে কথাও সত্য। কিন্তু, তাঁদের মৃত্যুকে ‘ব্যবহার’ করে যদি পশ্চিমবঙ্গে কাজের অভাবের কথাটি সমানেই বলা হতে থাকে, তাতে মনে হয় যে, রাজনীতির খোরাক হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু বুঝি এই মানুষগুলির প্রাপ্য ছিল না। শোককে তার প্রাপ্য সম্ভ্রমটুকু দিতে না পারলে যে অন্তত মুখ বন্ধ রাখতে হয়, রাজনীতি এ কথাটি সম্পূর্ণ ভুলে গেল কবে থেকে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement