আগুনের শিখা দেশ জুড়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। স্বাভাবিক। আগুপিছু না ভেবে কাজ করা অপরিণামদর্শী শাসকের অভিজ্ঞান, কিন্তু দেশের সেনাবাহিনী নিয়ে এ ভাবে না-ভেবে কাজ করার মধ্যে অপরিণামদর্শিতার চেয়েও বেশি কিছু আছে। বিক্ষুব্ধরা কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পটির মধ্যে দেখছেন লোক ঠকাবার কারিকুরি, আর রাজনৈতিক বিরোধীরা দেখছেন সেনাশিবিরে ভেদবুদ্ধি চালুর শয়তানি। ছোট আকারে পাইলট প্রজেক্ট কিংবা অভিজ্ঞ সেনাকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সেনার নামে কিছু অস্থায়ী শ্রমিক তৈরি করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হল। সর্বাধিক ছয় মাসের প্রশিক্ষণের পর মাসিক ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় মাত্র চার বছরের জন্য অস্থায়ী নিয়োগের নীতি, প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে চিকিৎসাভাতা কিছু না রাখা, চার বছর পর ২৫ শতাংশ বাদে বাকিদের ফের বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা— সব মিলিয়ে এই পরিকল্পনার মধ্যে ফাঁক আর ফাঁকির সমুদ্রসমান বন্দোবস্ত দেখছেন সম্ভাব্য আবেদনকারীরা। যদিও চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল মনোজ পান্ডের মতে অগ্নিবীররা সহজেই পাকিস্তান ও চিন সীমান্তে কাজ করতে পারবেন— এত কম সময়ের প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে তা আদৌ সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করছেন অন্যান্য উচ্চপদস্থ সেনা-কর্তা। সেনা নিয়ে এই ধরনের তর্ক-প্রতিতর্কের পরিসর তৈরি হওয়াই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়।
সবচেয়ে বড় ক্ষোভ স্বভাবতই, ‘অগ্নিবীর’দের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ৪৫ থেকে ৫০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের ৭৫ শতাংশ চার বছর পর বেরিয়ে এসে সিএপিএফ, রাজ্য ও রেল পুলিশ, নিরাপত্তা কর্মী, কিংবা ব্যাঙ্ক ও বিমা কোম্পানিতে আবেদন করতে পারবেন— কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা ছাড়াই— এই ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনা। বর্তমান ও প্রাক্তন সেনা অফিসাররা অবশ্য বলছেন, এত দিন অধিকাংশ সেনার ৩৭ বছরে অবসর হওয়ার পর তাঁরা যখন এই আবেদন করতেন, বহু ক্ষেত্রেই কোনও সুরাহা মিলত না। পুরনোদের ক্ষেত্রেই যা করা যায়নি, নতুন নিযুক্তদের ক্ষেত্রে তা করা যাবে কী করে? ক্ষোভের পরিমাণ দেখে সরকার এখন পিছু হটে কেন্দ্রীয় আধাসেনা বাহিনীতে এবং আসাম রাইফেলস-এ অগ্নিবীরদের জন্য দশ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা জানিয়েছে। তাজ্জব ব্যাপার। তা হলে সেনাবাহিনীর মতো অতীব গুরুত্বময় প্রতিষ্ঠানেও আগুন ছড়িেয় বিক্ষোভ করে নীতি পাল্টানো যায়?
তবে কি না, ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প এই দেশব্যাপী সুবৃহৎ বিক্ষোভাগ্নির প্রত্যক্ষ কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। একের পর এক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটের অতলে নিমজ্জমান সমাজ আজ সহ্যের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোভিডকালের অপশাসন, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য, বেকারত্বের ব্যাপকতা ও গভীরতা— সব মিলিয়ে দেশ এখন সঙ্কটে থরোথরো। এর মধ্যে ‘অগ্নিপথ’ একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, এখনই বিষয়টিকে পুনরালোচনার জন্য স্থগিত রা। তবে তার জন্য যে সততা ও সাহস লাগে, তাঁদের এর কোনওটিই নেই। তাঁরা ইশপের গল্পও পড়েননি: ‘ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না’। তাঁরা হয়তো এও জানেন না যে, সৈন্যদের কাজ শুধুই শত্রুকে পরাস্ত করা নয়। দেহরাদূনের মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কাঠের প্যানেলে খোদাই করা আছে যে আপ্তবাক্য, দেশের নিরাপত্তা, সম্মান ও কল্যাণই সর্বদা সেনার প্রথম কর্তব্য, সেনা-জীবনের নৈতিক ভিত্তি ওই মন্ত্র ও মূল্যবোধ। মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণে কি এই নৈতিকতায় জারিত হওয়া সম্ভব? না, মাত্র চার বছরের চাকরি জেনেও কি এই নৈতিক মানদণ্ডে স্থিত থাকা সম্ভব? দেশের সুরক্ষা কি ছেলেখেলা? না কি, আসলে আর কিছুই নয়, এই প্রকল্প ভাবা হয়েছিল কেবল সরকারের রাজনৈতিক সঙ্কটমোচনের নবতম গুহ্যপথ হিসাবে?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।