Polio Virus

পুরনো শত্রু

পোলিয়ো ভাইরাস এমন এক শত্রু, যাকে তাড়ালেও যায় না— সামান্যতম দুর্বলতার সুযোগে ফিরে ফিরে আসে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২২ ০৫:১৩
Share:

হায় ‘পোলিয়োমুক্ত ভারত’, হায় রে ‘স্বচ্ছ ভারত’। সব আস্ফালন তুচ্ছ করে ৮ বছর পর ফিরে এসেছে পোলিয়ো ভাইরাস, খাস কলকাতায়। মেটিয়াবুরুজ এলাকায় নর্দমার জলের নমুনায় সক্রিয় ভাইরাস মিলেছে, এ সংবাদ যেন লুডোর বোর্ডে সাপের হাঁ-মুখ— প্রশাসনের পরিকল্পনার ঘুঁটি বহু কষ্টে, বহু ব্যয়ে যত দূর এসেছিল, নিমেষে সেখান থেকে আবার নেমে গেল অনেকগুলো ধাপ। ফের নজরদারি, ফের সংক্রমিত শিশুর খোঁজ, পালস পোলিয়ো কর্মসূচি, আর প্রচারের পালা। পোলিয়ো ভাইরাস এমন এক শত্রু, যাকে তাড়ালেও যায় না— সামান্যতম দুর্বলতার সুযোগে ফিরে ফিরে আসে। প্রতিপক্ষ যখন অন্যমনস্ক, সতর্কতায় ঢিলে দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত, তখন সুযোগ বুঝে ফের হানা দেবে ভাইরাস, তাতে আর আশ্চর্য কী? কোভিড অতিমারির মোকাবিলায় টিকাকরণ কর্মসূচি কিছু দিন বন্ধ ছিল, তার পরেও সে দিকে যথাযথ মনোনিবেশ করা হয়নি। যার অন্যতম কারণ, টিকাকরণের সঙ্গে যুক্ত আশাকর্মীদের কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত। একই ভাবে, পুর এলাকাগুলিতে পতঙ্গবাহিত রোগের নজরদারি থেকে পুর স্বাস্থ্যকর্মীদের সরিয়ে আনার ফলে কলকাতা ও আশেপাশে ফের ডেঙ্গি দেখা দিয়েছে। অথচ, নিয়মিত টিকাকরণ-সহ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসুরক্ষার প্রতিটি দিক যে চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক করেছিলেন। বিশেষত গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের প্রকল্পগুলি নির্ধারিত লক্ষ্যে, নির্দিষ্ট সময়ে, অভ্যস্ত ছন্দে কাজ না করলে যে বহু দিনের বহু পরিশ্রম ব্যর্থ হবে, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়াবে দেশ, তার নানা সাক্ষ্য অতীতেও মিলেছে। আক্ষেপ, রাজ্য প্রশাসনের সকল দফতরই যেন আজ দমকল বিভাগকে ‘মডেল’ করে কাজ করছে— ঘাড়ের উপরে যে বিপদ এসে পড়েছে, তার মোকাবিলা করেই তাদের জীবনীশক্তি পৌঁছে যাচ্ছে তলানিতে। পরিণামের চিন্তা করবে কে?

Advertisement

পোলিয়োর পুনরাগমন বিশ্বের স্বাস্থ্য মানচিত্রে ভারতের স্থানটি দেখিয়ে দিল। অতিমারিতে টিকাকরণ কার্যসূচি ব্যাহত হওয়ায় এ বছর বেশ কিছু দেশে হাম-এর (মিজ়লস) সংক্রমণ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে সর্বাধিক সংক্রমণ মিলেছে যে পাঁচটি দেশ থেকে, সেগুলি হল সোমালিয়া, নাইজিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন এবং ইথিয়োপিয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই দেশগুলিতে টিকাকরণ ব্যবস্থায় গলদ থেকে গিয়েছে, অতিমারি সেইগুলিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। নতুন সংক্রমণ সেই অব্যবস্থার ইঙ্গিত। ভারতে পোলিয়ো ফিরে আসার অর্থ, শিশুস্বাস্থ্যের নিরিখে ভারতের স্থান এই দরিদ্র, যুদ্ধপীড়িত দেশগুলির সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে গত বছর নিয়মিত টিকাকরণ প্রকল্পের সুরক্ষা পেয়েছে মাত্র ষাট শতাংশ শিশু। দশ জন শিশুর চার জনই নিবারণযোগ্য অসুখের সামনে অসহায়, স্বাস্থ্য দফতরের এই তথ্য শঙ্কা জাগাতে বাধ্য।

আর লজ্জা জাগায় কলকাতার অনুন্নত, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির শৌচনিকাশির হাল। প্রতিটি পরিবারের জন্য ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার গঠন, মুক্তস্থানে শৌচের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের নিবারণ, এই সবই রয়ে গিয়েছে সরকারি প্রচারে। ২০১৯ সালে ভারতকে ‘মুক্তশৌচ থেকে মুক্ত’ ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) দেখিয়েছে, গ্রামীণ ভারতের তেতাল্লিশ শতাংশ পরিবারেই কোনও না কোনও সদস্য উন্মুক্ত স্থানে শৌচে যাচ্ছে। শহরের বস্তিগুলিতে এক-একটি শৌচাগার অনেকগুলি পরিবার ব্যবহার করে, শিশুরা খোলা নালায় শৌচে অভ্যস্ত। যা থেকে অসুখ ও অপুষ্টি অবধারিত। বার বার এ দেশ ফিরে আসে এই অনুভবে যে, উন্নয়নই প্রধান প্রতিষেধক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement