—প্রতীকী চিত্র।
বাংলার উচ্চশিক্ষায় যেন ভাটার টান। চলতি বছরে যেমন এ রাজ্যের কলেজগুলিতে বিজ্ঞানের মূল বিষয়, দর্শন, এমনকি অর্থনীতিরও এক বিপুল সংখ্যক আসন শূন্য পড়ে আছে। প্রসঙ্গত, এই বছরই প্রথম কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে স্নাতক স্তরে কেন্দ্রীয় ভাবে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। জানা গিয়েছে, লক্ষাধিক পড়ুয়া কেন্দ্রীয় ভাবে পোর্টালে প্রবেশ এবং নাম নথিভুক্তকরণ করেছিল। কিন্তু তার পরেও এত বেশি আসন ফাঁকা থেকে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের। অবস্থা এমনই যে, কলেজগুলিকে পুরনো পদ্ধতিতে কলেজের নিজস্ব পোর্টালের মাধ্যমে নতুন করে ফাঁকা আসন পূরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বেশ কিছু বছর ধরেই আসন ফাঁকা থাকার বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। কলকাতার কিছু নামী কলেজকে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে আসনসংখ্যাও কমাতে হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় এমন অনাগ্রহের একাধিক কারণ। অনেকে ২০২৩ সালে রাজ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-র প্রয়োগের প্রসঙ্গ তুলেছেন। চার বছরব্যাপী স্নাতক স্তরের পড়াশোনার বিষয়টি নিয়ে এখনও প্রশ্ন অনেক, নিঃসন্দেহে। এখানে শিক্ষার্থীরা তিন বছর পর পড়ায় ইতি টানলেও সে ডিগ্রি লাভ করবে, দু’বছর পর পড়া ছাড়লে লাভ করবে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট। কিন্তু কর্মজীবনে এই ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট কত দূর উপযোগী হবে, ধোঁয়াশা কাটেনি। তবে পশ্চিমবঙ্গের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা থাকার ছবি নতুন শিক্ষা নীতি প্রয়োগের পূর্ব থেকেই দেখা গিয়েছিল। অর্থনৈতিক কারণটি বোঝা সহজ। কর্মসংস্থানের সঙ্কট দীর্ঘ দিনের বাস্তব। কলেজ-শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর যে মানের কর্মসংস্থান হওয়া উচিত, দীর্ঘ দিন তার অভাব প্রকট। কোভিড-উত্তর কালে সেই সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। শিক্ষা-অন্তে চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় প্রথাগত পড়া চালিয়ে যাওয়া অপচয় মনে করা হচ্ছে। কোভিডকালে অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে যেতে না পারায় বহু শিক্ষার্থী শিক্ষার পথ ছেড়ে উপার্জনে প্রবৃত্ত হয়েছিল। কোভিড-পরবর্তী যুগে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি আসেনি, উচ্চশিক্ষায় অনীহাও অব্যাহত থেকেছে।
লক্ষণীয়, এই সময়কালে রাজ্যের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে এই শিক্ষালয়গুলি বাজার উপযোগী বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করে, যাতে শিক্ষা-অন্তে শিক্ষার্থী দ্রুত চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই নগদ অর্থের বিনিময়ে এই কলেজগুলিতে ভিড় বেড়েছে। অন্য দিকে, সংরক্ষণ নীতিও আসন খালি থাকার জন্য কিয়দংশে দায়ী। রাজ্য স্তরে আসন সংরক্ষণের হার ৪৫ শতাংশ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই সংরক্ষিত আসনের এক বড় অংশ ফাঁকা থেকে যায়। জনজাতি ও প্রান্তিক শ্রেণিকে শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসার জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তা যাতে ফলপ্রসূ হয়, তার জন্য সরকারকে আগ্রহী হতে হবে। উচ্চশিক্ষায় এই ক্রমবর্ধমান অনাগ্রহ বিশেষ উদ্বেগের কারণ। এমনিতেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিকাঠামোগত সমস্যায় ধুঁকছে। শিক্ষার্থীরাও মুখ ঘোরালে তার আঘাত সার্বিক ভাবে রাজ্যের শিক্ষায় পড়তে বাধ্য। মানবসম্পদ যেখানে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভর, সেই পরিস্থিতিতে এমন বিপদসঙ্কেত রাজ্য সরকার ঠিকমতো পড়তে পারছে কি?