নিতান্ত অকারণেই তিনটি প্রাণ চলে গেল দিল্লিতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হাজির হন দিল্লির রাজেন্দ্রনগর, মুখার্জিনগর এলাকায়— ইউপিএসসি-র কোচিং রাজধানী এখানেই। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের দেশব্যাপী খ্যাতি। যে সেন্টারটিতে এই দুর্ঘটনা ঘটল, সেটিও যথেষ্ট পরিচিত। ইউপিএসসি-র কোচিংকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের অর্থনীতি আবর্তিত হয়। ফলে, তার গুরুত্বের কথা প্রশাসন ও পুলিশের অজ্ঞাত থাকার তিলমাত্র কারণ নেই। কী ভাবে এই সেন্টারগুলি চলে, ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে থাকতে বাধ্য হন, সে কথাও বিলক্ষণ জানা। দুর্ঘটনার পরে এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা এক ছাত্র সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠি লিখে সেই দুর্দশার কথা জানিয়েছেন। এমন দুর্ঘটনা ঘটা যে আদৌ অস্বাভাবিক নয়, বরং তা সময়ের অপেক্ষামাত্র ছিল, এ কথা স্পষ্ট। প্রশ্ন হল, সব জানা সত্ত্বেও পুলিশ-প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল কেন? সংবাদে প্রকাশ, এই দুর্ঘটনার পরে পুলিশ সেই অঞ্চলে অনেকগুলি কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে— জানিয়েছে যে, প্রতিটি সেন্টারেই এমন বেআইনি ভাবে বেসমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছিল। এই কড়া পদক্ষেপ করার জন্য তিনটি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হল কেন? প্রশ্নটির উত্তর ভারতবাসীর জানা— যত ক্ষণ না এমন কোনও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, তত ক্ষণ অবধি কোনও চাপ তৈরি হয় না পুলিশের উপরে। এবং, চাপে না পড়লে পুলিশ-প্রশাসন নিজেদের দায়িত্ব ভুলে থাকতেই অভ্যস্ত। সেই বিস্মরণ অবশ্য অহেতুক নয়— কান পাতলেই অভিযোগ শোনা যায় যে, কাঞ্চনমূল্যে এমন বিস্মরণ কিনে নেয় আইনভঙ্গকারী ব্যবসায়ীরা।
সমস্যা শুধু রাজেন্দ্রনগর-মুখার্জিনগরের নয়, শুধু দিল্লিরও নয়। ব্যবসায়িক লাভের পরিমাণ বাড়াতে আইন ভাঙা, এবং সেই লাভের কিয়দংশ দিয়ে পুলিশকে সন্তুষ্ট রাখা— এই ব্যাধিতে ভারতের প্রতিটি জনপদ আক্রান্ত। কোনও ব্যবসায়িক উদ্যোগ থেকে আইনত যতখানি লাভ করা সম্ভব, তার চেয়ে বেশি উপার্জনের তাগিদটি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও, অতি পরিচিত। স্বভাবতই পুলিশ-প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত এই জাতীয় বেআইনি কাজকর্ম করে চলা যায় না। যে বেসমেন্টের ছাড়পত্র গুদাম হিসাবে ব্যবহার করার জন্য, এলাকার সব কোচিং সেন্টারই যদি তাকে লাইব্রেরি হিসাবে বা অন্য কোনও ভাবে ব্যবহার করে চলে, সামান্য নজরদারিতেই তা ধরা পড়ার কথা। অতএব, আঙুল তুলতে হলে তা একই সঙ্গে এমন অসাধু ব্যবসায়ী এবং পুলিশ-প্রশাসনের দিকে তোলা বিধেয়। দিল্লির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কোচিং সেন্টারটির মালিক ও আধিকারিক গ্রেফতার হয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশের কর্তাদেরও জবাব দেওয়ার দায় রয়েছে যে, তাঁঁরা এমন মরণকূপ চলতে দিচ্ছিলেন কেন? এই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি, যাতে ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রলোভনে কেউ নিজেদের দায়িত্ব বিস্মৃত হওয়ার সাহস না পান। প্রশ্ন উঠবে দিল্লি পুরসভার ভূমিকা নিয়েও— নিকাশি পরিস্থিতি এমন হতশ্রী যে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়লেই এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। যে কাজে নাগরিকের জীবনহানি অবধি ঘটতে পারে, সেই কাজ যে করে চলা যায় না, এই বার্তাটি অত্যন্ত কঠোর ভঙ্গিতে দেওয়া প্রয়োজন। তবে আশঙ্কা হয়, সাময়িক হইচই মিটলেই আবার সবই যথা পূর্বং হয়ে যাবে। শহর অপেক্ষা করবে পরবর্তী বিপর্যয়ের।