কে ন এত জওয়ানের মৃত্যু? কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ঢিলাঢালা? ছত্তীসগঢ়ের সুকমায় ২৫ সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর পর প্রশ্নের রেশ ফুরাইতে না ফুরাইতেই কাশ্মীরে আবার জঙ্গি হানা। লক্ষণীয়, ভারতীয় নিরাপত্তার অন্দর বাহির, উপর নিচ সর্বস্তরব্যাপী পেশাদারিত্ব ও তৎপ্রসূত দক্ষতার কী চূড়ান্ত অভাব। কী সামরিক বাহিনী, কী কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী— নিরাপত্তারক্ষীদের সুরক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি চার দিকে প্রকট। জঙ্গি বা মাওবাদীরা যে আত্মঘাতের জন্য মনস্থির করিয়া তবেই আক্রমণে উদ্যত হয়, ইহা মাথায় রাখিলে বোঝা সহজ, তাহাদের কয়েক জনকে মারিয়া খুব বড় কৃতিত্ব দাবি করা আসলে হাস্যকর। বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতার পরিমাপ হইতে পারে— তাহার নিজের দিকের লোকগুলিকে ঠিকঠাক বাঁচানো সম্ভব হইতেছে কি না, তাহার হিসাব। আর সেই হিসাব অনুযায়ী, সেনাবাহিনী বা সিআরপিএফ, কাহারও রেকর্ড ভরসাদায়ক নয়। ছত্তীসগঢ়ের সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে, মাওবাদীরা চাহিলেই লক্ষ্য সাধন করিতে পারে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থাই হউক, নিরাপত্তাবাহিনীর ‘অপারেশন’ পদ্ধতিই হউক, মাওবাদীদের ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে টক্কর দিবার যোগ্যতা ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তির নিকট অধরা। সুকমার ঘটনার পরে নিরাপত্তাবাহিনীর গোপন তথ্য ফাঁস এবং অভিযান পদ্ধতির ফাঁকফোকর লইয়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নাকি উদ্বিগ্ন। সিআরপিএফ-এর ডিজি পদটি পূর্ণ করিবার কথা শোনা যাইতেছে। বিস্ময় হইল, রাষ্ট্রিক নিরাপত্তার মতো বিষয়ে উচ্চ নেতৃত্ব নিয়োগের সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য মাওবাদী সৌপ্তিকপর্বের অপেক্ষা করিতে হয়! মাওবাদীদের গুপ্তচর নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেই ছড়াইয়াছে কি না, সেই তদন্তের জন্য রক্তাক্ত আক্রমণ অবধি ধৈর্য ধরিতে হয়! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের উদ্বেগের সময়-নির্বাচনই বলিয়া দেয়, সমস্যার মূলটি কোথায়।
মন্ত্রক স্বীকার করিতেছে, সমস্যা একটি নহে, অনেক। অর্থাৎ, ব্যর্থতা একটি নয়, অনেক। যুদ্ধবাহিনীর মৌলিক কর্মপদ্ধতি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর) বলিয়া একটি কথা আছে। এক সঙ্গে না হাঁটিয়া ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয়া যাওয়া, একত্র খাইতে না বসা, পথ পাল্টাইয়া হাঁটাহাঁটি করা, ইত্যাদি নানা কৌশল তাহার অঙ্গ। অভিযোগ, ছত্তীসগঢ়ে ইহার কোনওটিই মানিয়া চলা হয় নাই, ফলে গুপ্তচর বা তথ্যসন্ধানী সহজেই তথ্য জানিয়াছে। দ্বিতীয়ত, রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের ঘাটতি, এমনকী মতান্তরের অভিযোগও আছে। এই বাহিনী লইয়া মাওবাদীদের মোকাবিলা? তৃতীয়ত, লিখিত হিসাব অনুযায়ী ছত্তীসগঢ়ে যত পুলিশ থানা থাকিবার কথা, বাস্তবে তাহার অধিকাংশই হয় নাই, নয় নামমাত্র। চতুর্থত, অন্ধ্রপ্রদেশে বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনী সাফল্য পাইয়াছিল। ছত্তীসগঢ়ে কিন্তু এখনও তাহাদের পাঠানো হয় নাই।
আর একটি ব্যর্থতাও আছে, রাজনীতি/কূটনীতি হইতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আলাদা করিতে না পারা। মাওবাদীদের সহিত মোকাবিলার কী নীতি হইতেছে, কিংবা পাকিস্তানের সহিত এই মুহূর্তে সমীকরণ কোথায় দাঁড়াইয়া আছে, এ সব রাজনৈতিক ওঠাপড়ার সহিত নিরাপত্তা বাহিনীর মানসিক কিংবা ব্যবহারিক প্রস্তুতির কোনও সম্পর্ক নাই। বাহিনীকে সর্বদা এক শত শতাংশ প্রস্তুত থাকিতে হইবে। ইহাই তাহাদের কাজ। অভ্যন্তরীণ বা সীমান্তবর্তী, কোনও নিরাপত্তা মুহূর্তেকও ঢিলা হইবে না, দক্ষ রাষ্ট্রের নীতি ইহাই বলে। বর্তমান সরকার কথায় কথায় জাতীয়তাবাদের বুলি আউড়ায়, অথচ জাতীয়তাবাদ বলিতে যে গরু, সংগীত, পতাকা ইত্যাদি ছাড়া আরও কিছু বোঝায়, সে কথা মাথায় রাখে না। রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা লইয়া অক্ষমণীয় ভাবে উদাসীন থাকে। বাগাড়ম্বর দিয়াই কি সব কাজ হয়?