প্রবন্ধ ১

দরজা ফাঁক হয়েছে, বিরোধীরা ঢুকুন

জেটলি গ্রামের উন্নয়নের কথা যত বললেন, ততটা আসলে সত্যি নয়। কিন্তু, ট্রিকল ডাউনের পথ থেকে সরার সম্ভাবনা তৈরি হল। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর দায়িত্ব বিরোধীদের। দু’বছরের বিচ্ছেদ পেরিয়ে অবশেষে গ্রাম ফেরত এল কেন্দ্রীয় বাজেটে। ফিরে এল কৃষিও। গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় কৃষি নিয়ে বরাদ্দ হয়েছিল সাকুল্যে ৩৪০ শব্দ। এ বছর, প্রায় সাড়ে বারোশো। কেন, অনুমান করা চলে। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতের মাটিতে গ্রামকে, কৃষিকে বাদ রেখে রাজনীতির রথের চাকা বেশি দূর গড়াবে না।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৬ ০০:৩৯
Share:

দু’বছরের বিচ্ছেদ পেরিয়ে অবশেষে গ্রাম ফেরত এল কেন্দ্রীয় বাজেটে। ফিরে এল কৃষিও। গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় কৃষি নিয়ে বরাদ্দ হয়েছিল সাকুল্যে ৩৪০ শব্দ। এ বছর, প্রায় সাড়ে বারোশো। কেন, অনুমান করা চলে। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতের মাটিতে গ্রামকে, কৃষিকে বাদ রেখে রাজনীতির রথের চাকা বেশি দূর গড়াবে না। নরেন্দ্র মোদীরা টের পেয়েছেন, যে স্লোগান তাঁদের ২০১৪ সালে মসনদে বসিয়েছিল, ২০১৯ সালে তাতে কাজ হবে না। যে গ্রাম এত দিন বাঁচিয়েছে, বাঁচালে আবারও সেই গ্রামই বাঁচাবে।

Advertisement

শুধু ভোটের খাতিরেই নয়, বাজারের খাতিরেও গ্রামীণ ভারতের খানিক ভাল থাকা প্রয়োজন। বাজেটের গোড়াতেই অরুণ জেটলি জানিয়ে রেখেছেন, বিশ্ব-অর্থনীতি বেহাল, কাজেই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার দিকেই তাকাতে হবে। সপ্তম বেতন কমিশনের দৌলতে যতই সরকারি চাকুরেদের মাইনে বাড়ুক, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে হলে গ্রামীণ বাজারের দিকে তাকাতেই হবে। এ দিকে, গত এক বছরে গ্রামাঞ্চলে চাহিদা কমেছে ১৫ শতাংশের বেশি, গ্রামীণ মজুরি বেড়েছে মাত্র ২.১ শতাংশ। এই বাজারকে চাঙ্গা করা তাই জরুরি হয়ে প়ড়েছে।

অরুণ জেটলি পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কোন ম্যাজিকে তা সম্ভব হবে, বলেননি। গত চার বছরে কৃষিতে আয়বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১.৫, ৪.২, -০.২ এবং ১.১ শতাংশ। পর পর দু’বছর খরার কবলে পড়েছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেই খরার বিপদের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার কতখানি তৎপর হয়েছিল, গ্রামমুখী বাজেটের দিন এক বার সে কথা ফিরে দেখা যেতে পারে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে এ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে খরার ত্রাণ বাবদ মোট ৩৮,৬০০ কোটি টাকার চাহিদা ছিল। সরকার ১৩,৫৪৯ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু দিয়েছিল মাত্র ২৩৮৬ কোটি টাকা। মোট চাহিদার ছয় শতাংশ, নিজেদের প্রতিশ্রুতির সাড়ে সতেরো শতাংশ। কাজেই, এই বাজেটের প্রতিশ্রুতিরও কতখানি বাস্তবায়িত হবে, প্রশ্ন থাকছে।

Advertisement

পরিসংখ্যান বলছে, অর্থমন্ত্রী যত আড়ম্বরে ঘোষণা করলেন, আসলে গ্রামের জন্য ততখানিও দিচ্ছেন না। জাতীয় আয়ের অনুপাতে ২০১৩-১৪ সালে, ইউপিএ-র শেষ বাজেটে, সামাজিক ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছিল ১.২ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষেও প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ০.৭ শতাংশ। আর, এ বছর জেটলি বরাদ্দ করলেন ০.৬ শতাংশ। ২০১৩-১৪ সালের বাজেটে গ্রামোন্নয়নে বরাদ্দ হয়েছিল জাতীয় আয়ের ১.৮ শতাংশ। এই বাজেটে জেটলি দিলেন ১.৫ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী সত্যি কথাগুলো খুলে না-ই বলতে পারেন, পরিসংখ্যান মিথ্যে বলে না।

পুরনো প্রকল্পকেই ফের নতুন মোড়কে পেশ করে দিলেন কি না অর্থমন্ত্রী, সেটাও খতিয়ে দেখা ভাল। যেমন, প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা। গত বাজেটেই ছিল প্রকল্পটি। বরাদ্দ হয়েছিল সামান্য টাকা, ১৮০০ কোটি। এক বছরে কেন্দ্র তারও এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে উঠতে পারেনি। গত বাজেটেও কৃষিক্ষেত্রে ঋণের জন্য সাড়ে আট লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তার কতখানি কৃষকের হাতে পৌঁছেছে, সে হিসেব এখনও স্পষ্ট নয়। এ বছর অর্থমন্ত্রী নয় লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করে সর্বকালের সর্বোচ্চ বরাদ্দের ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে রেখেছেন। কাজেই, গ্রামের প্রাপ্তির হিসেব কষার সময় সাবধান হওয়া ভাল।

হয়তো সত্যিই নির্বাচনী অঙ্কের খাতিরে, বাজারের চাহিদার কথা ভেবে গ্রামের দিকে নজর ফেরানোর কথা বলছেন মোদী-জেটলিরা। মুখে যতখানি বলেন, কার্যক্ষেত্রে গ্রাম ততখানি গুরুত্ব পায় না তাঁদের কাছে। কিন্তু, এই বাজেটে যেটুকু হল, তাতে কি গ্রামীণ ভারতের লাভ হতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু নেতিবাচক নয়। তবে, উত্তরটা অর্থনীতিরও নয়। রাজনীতির। বিরোধী রাজনীতির। দেখাই যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদীরা তাঁদের ‘চুঁইয়ে পড়া উন্নয়ন’-এর ট্রিকল ডাউন তত্ত্ব থেকে সরে এসেছেন। জগদীশ ভগবতী শিউরে উঠবেন, কিন্তু সত্যিই এই বাজেটে উন্নয়নের যে পথের স্বীকৃতি রয়েছে, মোদীরা সে পথের পথিক হিসেবে পরিচিত নন। রাজনীতির চাপ তাঁদের ‘স্বধর্ম’ থেকে বিচ্যুত করেছে। প্রশ্ন হল, বিরোধীরা কি সেই চাপ আরও বাড়িয়ে যেতে পারবেন? মোদীকে গুজরাত মডেলের বাইরে বেরিয়ে উন্নয়নকে দেখতে বাধ্য করতে পারবেন? পারলে, এই বাজেটে গরিব মানুষের জন্য অনেক কিছু আছে, না পারলে নেই।

সম্ভাবনার দরজা এক বার খুললে যে অনেক কিছু হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা। ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘মনরেগা’ হল কংগ্রেসের ব্যর্থতার জলজ্যান্ত প্রমাণ। অরুণ জেটলির বাজেট বলছে, এই অবস্থান থেকে কার্যত একশো আশি ডিগ্রি সরে গিয়েছেন তাঁরা। এ বারের বাজেটে মনরেগার খাতে বরাদ্দ হল ৩৮,৫০০ কোটি টাকা। গ্রামীণ পরিকাঠামো তৈরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘মনরেগা’-কে কাজে লাগানো হবে, তা-ও জানালেন তিনি। যে প্রকল্পটির সর্বাঙ্গে ইউপিএ এবং সনিয়া গাঁধীর জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের ছাপ, শত অনিচ্ছাতেও সেই প্রকল্পটিকে বহাল রাখতে বাধ্য হলেন জেটলিরা। কারণ, ইউপিএ আমলের শেষ দিকে অথবা এনডিএ-র প্রথম দু’বছরে যতই অযত্নে চলুক প্রকল্পটি, তার বিপুল সম্ভাবনার কথা মানুষ জেনে গিয়েছেন। অর্থাৎ, দরজাটি খুলে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষ জানেন, এই প্রকল্পটি থাকলে তাঁদের অন্তত কিছু দিনের রোজগারের নিশ্চয়তা থাকবে। ফলে, সরকার হাত গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেই মানুষ ক্ষুব্ধ হন। সেই ক্ষোভ উগরে দেন ভোটের বাক্সে। বিরোধীদের কাজ হল এই ক্ষোভের আগুনকে কিছুতেই নিভতে না দেওয়া।

অরুণ জেটলির বাজেটেও অনেকগুলো দরজা ফাঁক হয়েছে। যেমন, দেশের ১০০ শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁদের শপথগ্রহণের সময় যতগুলো গ্রাম বিদ্যুৎহীন ছিল, তার ৮৫ শতাংশে নাকি ইতিমধ্যেই সংযোগ পৌঁছে গিয়েছে। সেই ‘পৌঁছনো’ মানে কী, আমরা জানি। খুঁটি পোঁতা হয়েছে, সেই অবধি তার পৌঁছেছে। বাড়িগুলো, প্রায় নিশ্চিত ভাবেই, এখনও অন্ধকার। কিন্তু ওই খুঁটি পৌঁছে যাওয়াটাও কম কথা নয়। বস্তুত, সেখান থেকেই বিরোধীদের কাজ শুরু হয়। খুঁটি যখন এসেছে, তখন প্রত্যেকটা বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে, এই দাবি তোলার কাজ। সেই দাবিতে অনড় এবং সক্রিয় থাকার কাজ। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি পৌঁছে যাওয়া আসলে একটা সম্ভাবনার দরজা খুলে যাওয়া। সেই দরজা দিয়ে কত দূর ঢোকা সম্ভব হবে, সেটা নির্ভর করে বিরোধীদের ওপর।

ফসল বিমাও তেমনই একটি সম্ভাবনার দরজা। শুধু বিমার প্রিমিয়াম মকুব করে যে কাজের কাজ তেমন একটা হয় না, সেটা বিভিন্ন রাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট। আচরণবাদী অর্থনীতির তত্ত্ব বলবে, যত ক্ষণ না কৃষকদের বিবিধ দুশ্চিন্তা লাঘব হচ্ছে, তত ক্ষণ অবধি নিখরচায় বিমা করানোর ব্যবস্থা থাকলেও তাঁরা তা করিয়ে উঠতে পারেন না। সন্তানের শিক্ষা, বৃদ্ধ মা-বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থার মতো চিন্তা, ফসল উৎপাদনের পর ন্যায্য মূল্যে তার বিক্রির ব্যবস্থার চিন্তা, আকস্মিক প্রয়োজন মেটানোর অর্থ সংস্থানের চিন্তা— এগুলোর সুরাহা না হলে শুধু কৃষিবিমা তেমন কার্যকর হবে না। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিবিমার ব্যবস্থা করলে বিরোধীদের দায়িত্ব বাড়ে। ‘ও সব ফালতু লোক দেখানো প্রকল্প’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার বদলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা বিরোধীদের দায়িত্ব— এই বিমা যাতে সত্যিই কার্যকর হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করার চাপ। যে কাজগুলো না করা পর্যন্ত কৃষকদের চিন্তা কমার উপায় থাকে না, সেই কাজগুলো করিয়ে নেওয়ার চাপ।

এই বাজেটে সেই চাপের রাস্তাও খুলেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করে জেটলি এক অর্থে মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন। ইউপিএ-র দশ বছরে দেশের গরিব মানুষ কাজের অধিকার পেয়েছিলেন, খাদ্যের অধিকার পেয়েছিলেন। শিশুরা শিক্ষার অধিকার পেয়েছিল। ভারতে কল্যাণ অর্থনীতির একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, যেখানে গরিব মানুষের উন্নয়ন রাষ্ট্রের বদান্যতার ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং সেই উন্নয়ন তাঁদের অধিকার। স্বাস্থ্যের অধিকার সেই প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। কাজেই, ট্রিকল ডাউন তত্ত্বে যাঁদের বিশ্বাস নেই, তাঁদের কর্তব্য হল নরেন্দ্র মোদীর ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে স্বাস্থ্যের অধিকারের প্রশ্নটি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিমাতেই থেমে না যায়। সরকার যাতে সত্যিই এই অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। গরিব মানুষ যাতে হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবি করতে পারে, এবং সেই দাবি স্বীকার করতে রাষ্ট্র যাতে বাধ্য থাকে, তা নিশ্চিত করা বিরোধীদের কাজ। এটা তো তাঁদের নীতিরই পরের ধাপ, কাজেই সেই দাবিতে জান লড়িয়ে দিতে তাঁদের আপত্তি থাকার কথা নয়।

ভারতে এখন গণতন্ত্র নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। বাক্‌স্বাধীনতা অথবা বহুস্বরের দাবি, দেশের বহুমাত্রিক চরিত্র রক্ষার প্রয়াস, সবই গণতন্ত্রের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি লড়াই। কিন্তু, গণতন্ত্র মানে শুধু সেটুকুই নয়। দেশের সর্বাধিক মানুষের জন্য উন্নয়নের কোন পথটি ভাল, সেই তর্ক চালিয়ে যাওয়াও গণতন্ত্রের জরুরি কাজ। সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে তাকে সর্বজনের হিতে কাজ করতে বাধ্য করা গণতন্ত্রেরই অনুশীলন। বিশেষত, সরকার যখন সম্ভাবনার দরজাগুলো ফাঁক করছে, তখন যত দূর সম্ভব ঠেলে এগিয়ে যাওয়াই কাজ।

উন্নয়নের পথ তৈরি করা যে শুধু সরকারেরই কাজ, কে বলল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement