বৃহস্পতিবার মেরঠে নির্বাচনী প্রচারে। ছবি: পিটিআই।
রাহুল গাঁধী ‘মিশন শক্তি’র জন্য ডিআরডিও’কে অভিনন্দন জানাইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্ব থিয়েটার দিবসের শুভেচ্ছা জানাইতে ভুলেন নাই। উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষায় সাফল্য ঘোষণার দিনটির এই বিশেষ পরিচয় খেয়াল করিবার জন্য কংগ্রেস সভাপতি তথা তাঁহার পরামর্শদাতাদের মানসিক তৎপরতাকে নরেন্দ্র মোদী অভিনন্দন জানাইবেন বলিয়া মনে হয় না— তাঁহার বা তাঁহার সতীর্থদের রসবোধ, তাঁহাদের নাট্যরসের মতোই, চড়া দাগের। চড়া দাগের নাটকই আরও এক বার মঞ্চস্থ হইল বুধবার দ্বিপ্রহরে। মোদীজি নিজগুণে এই অভূতপূর্ব কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছেন যে ‘প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিবেন’ শুনিলেই ছাপোষা নাগরিকের হৃৎকম্প হয়। অগণন দেশবাসীকে বেশ কিছু ক্ষণ সেই তীব্র উদ্বেগে রাখিয়া প্রধানমন্ত্রী অবশেষে যে খবর জানাইলেন তাহাতে দেশ জুড়িয়া স্বস্তির সমবেত দীর্ঘশ্বাস নির্গত হইল বটে, কিন্তু মহাকাশে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্বে সঞ্চরমাণ কৃত্রিম উপগ্রহ তিন মিনিটে ধ্বংস করিবার সাফল্য ঘোষণার নাটকটি হয়তো নাটক হিসাবে তেমন জমিল না। নাট্যকারের ঝুলিতে আরও রোমাঞ্চকর কোন চিত্রনাট্য রূপায়ণের প্রতীক্ষায়, ঘরপোড়া নাগরিকরা বোধ করি তাহাই ভাবিতেছেন।
কিন্তু রাহুল গাঁধীও মানিবেন, এই দেশে নাটক জনপ্রিয়। বিশেষত নরেন্দ্র মোদীর জমানায়। আপনার ঢাক আপনি পিটাইবার নাটকীয় তৎপরতাকে সমাজও দিব্য পছন্দ করে। ইউপিএ জমানার দ্বিতীয় পর্বে ‘নীতিপঙ্গুতা’র পাশাপাশি, হয়তো একই কারণে, মনমোহন সিংহেরা নিজেদের কৃতিত্বের কথা মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিতেন না। মোদীর প্রবল প্রচার অভিযানের পাশে তাঁহাদের সেই নির্বাক দশা ভোটাররা ভাল চোখে দেখেন নাই। আজও মোদীর কথার দাপটকে যদি অনেকেই কর্মঠতার প্রমাণ বলিয়া মনে করেন, তাহা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য। এহ বাহ্য। একটি প্রাথমিক প্রশ্নের সদুত্তর বিরোধীদের কাছে নাই। ক্ষেপণাস্ত্রটি যদি আগেই প্রস্তুত ছিল, তবে পূর্ববর্তী সরকার তাহার পরীক্ষা সারিয়া লয় নাই কেন? আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা বা বিধ্বস্ত উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষে আকাশ আকীর্ণ হইবার সম্ভাবনা যদি তাহাদের নিরস্ত করিয়া থাকে, তবে সেই কথা বিরোধীরা সাফ সাফ বলিতেছেন না কেন? ‘দেশবিরোধী’ প্রতিপন্ন হইবার ভয়ে? অতঃপর নরেন্দ্র মোদী ও পারিষদবর্গ যখন বলিবেন, ‘‘উহারা পারে না, আমরা পারি’’, তখন বহু নাগরিকই যদি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন, তাঁহাদের পাইকারি ভাবে মোদীভক্ত বলিয়া দাগিয়া দিতে চাহিলে তাহা ভাবের ঘরে চুরি হইবে না কি?
একটি সত্য স্পষ্ট। ‘সফল’ ক্ষেপণাস্ত্রটি লইয়া এত নাটক করিবার কিছু নাই, কিন্তু তাহাকে তুচ্ছ করাও চলে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৯৫৯), সোভিয়েট ইউনিয়ন (১৯৬৩) এবং চিনের (২০০৭) পরে ভারত এই কৃতিত্ব অর্জন করিয়া নিশ্চয়ই ‘মহাকাশ-প্রতিরক্ষা’য় ওই দেশগুলির সমকক্ষ হয় নাই, এমনকি চিনও এখনও তাহার অনেক আগে। কিন্তু প্রতিরক্ষা গবেষণায় অগ্রগতির সূচক হিসাবে এই সাফল্য মূল্যবান। মূল্যবান প্রতিরক্ষা নীতির সূচক হিসাবেও। কূটনীতির দুনিয়ার চরিত্রে গত কয়েক বছরে বড় রকমের পালাবদল ঘটিয়াছে। বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা অনেক পুরানো অঙ্ক দ্রুত এবং আকস্মিক ভাবে বদলাইয়া দিয়াছে। ‘আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া’র আশঙ্কায় আগে যাহা করা যাইত না, আজ হয়তো তাহার অনেক কিছুই সম্ভব। বস্তুত, আন্তর্জাতিক কূটনীতিক এখন অনেকাংশেই সম্ভাব্যতার শিল্প, এক পা আগাইয়া খেলিবার সুযোগ সেখানে আছে। মোদী সেই সুযোগ কাজে লাগাইতেছেন। বালাকোটে এক ভাবে, মহাকাশে অন্য ভাবে। তাঁহার নাটক দেখিতে গিয়া এই গভীরতর কৌশলটি না-দেখিলে ভুল হইবে।