দ শ বৎসর পর ব্রিটেন আবার আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল। ২০০৭ সালের জুলাই মাসের সন্ত্রাসকাণ্ডের পর সে দেশে জঙ্গি কার্যকলাপ কিছুটা সীমিত হইয়া আসিয়াছিল, বড় অঘটন ঘটে নাই। ফলে বহু সামাজিক অস্থিরতার মধ্যেও একটি স্বাভাবিকতা ব্রিটেনবাসীর অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। এক ধাক্কায় সেই স্বস্তির বাঁধ ভাঙিয়া গেল। এখন ম্যাঞ্চেস্টার-সহ দেশের নানা শহর, এমনকী লন্ডনও, প্যারিসের মতো গভীর উদ্বেগে ত্রস্ত। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য অপেক্ষমাণ ব্রিটিশ সমাজ বুঝিয়া লইতেছে, ইহার মধ্য দিয়াই তাহাকে হাঁটিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে যদিও রীতিমাফিক বক্তৃতায় বলিয়াছেন, তাঁহার দেশ এই ভয়ের সামনে ভাঙিয়া পড়িবে না, সেই আশ্বাস অনেককে বিরক্ত ও বিচলিত করিয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, অনুষ্ঠানস্থল ভর্তি কিশোরকিশোরী যুবকযুবতী এমনকী শিশুদের উপর যেখানে অবলীলায় মরণহানা চালানো যায়, আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেখানে প্রত্যহ বুলেটপ্রুফ বুদ্বুদের মধ্যে বাস করেন, সেখানে নেতারা নাগরিকদের কোন যুক্তিতে ‘ভরসা’ দেন, কোন মুখে ছেলেমেয়েদের আনন্দ-অনুষ্ঠানে ‘নির্ভয়ে’ শামিল হইতে বলেন? ভয়ের হাত হইতে সাধারণ মানুষকে বাঁচাইবে কে?
এইখানটিতেই আইএস তাহার বৃহত্তম সাফল্য দাবি করিতে পারে। তাহারা যাহা করিতে চাহিয়াছিল তাহা সর্বার্থে সুসম্পন্ন: দশ বৎসর পর ব্রিটেনে আবার পদে পদে মৃত্যুভয় জাগাইয়া দেওয়া গিয়াছে। যে ধরনের প্রতিক্রিয়া তাহারা তৈরি করিতে চাহে, তাহাও সাধিত। আইএস-এর লক্ষ্য, যুদ্ধ জারি করা। সেই যুদ্ধে জয়পরাজয় গৌণ, সন্ত্রাস সৃষ্টিই তাহার উপায় ও লক্ষ্য। এক আঘাতে সেই ত্রাস আবার জাগ্রত। এবং আবারও কয়েক ধাপ চড়িয়াছে জঙ্গিবিরোধী, এমনকী ইসলামবিরোধী তর্জনগর্জন। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে ইতিমধ্যেই আবার সেই গুঞ্জন-কলরব— এই বর্বরতা জঙ্গি ইসলামের চরিত্রানুগ, সুতরাং ইহার মূলোৎপাদন, এবং সেই সূত্রে ইসলামি অভিবাসীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ভিন্ন এই আতঙ্কের শেষ নাই। অভিযোগ উঠিয়াছে, লন্ডন মেয়র সাদিক খান নাকি বর্বরতার নিন্দা করিয়াও আইএস-এর নাম করেন নাই। সে দিনের জঙ্গি যুবা যেহেতু এক অভিবাসী লিবীয় মুসলিম দম্পতির ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী সন্তান, অভিবাসন নীতির সমালোচনাও আবার তুঙ্গে।
বিপরীত অসহনশীলতার প্রবণতাটিও লক্ষণীয়। ব্রিটেনে দীর্ঘ কাল পর্যন্ত সহনশীলতার ঐতিহ্য খুবই জোরদার ছিল। সিরীয় উদ্বাস্তু-প্রবাহের বিরোধিতায় ও ব্রেক্সিট আন্দোলনের প্রাবল্যে সেই ঐতিহ্য ভাঙিয়া গিয়াছে। ম্যাঞ্চেস্টারের ঘটনা সেই ভাঙনের বেগ বাড়াইয়া দিবে, এই আশঙ্কা অমূলক নহে। নির্বাচন যেহেতু দোরগোড়ায়, ব্রেক্সিটপন্থী কনজারভেটিভ পার্টির এই আতঙ্কের আবহ হইতে সুবিধা লাভ করিবে, এমন আলোচনাও শুরু হইয়া গিয়াছে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠিতেও বাকি নাই। লেবার পার্টির নেতারা অবশ্য অনেকেই অনুরোধ করিয়াছেন, জাতীয় বিপর্যয়ের সময়ে এই সব দুর্ভাগ্যজনক গুজবে কান না দিতে। কিন্তু সামাজিক ক্রোধ ও অসহায়তা সেই সুবচনে কতটা প্রশমিত হইবে, তাহা দেখিবার। ম্যাঞ্চেস্টার কেবল নিজে বিপন্ন হয় নাই, জাতীয় জীবনের এক গুরুতর মুহূর্তে গোটা দেশকে বিপন্ন করিয়া দিল।