জলপাইগুড়ির গরুমারা অভয়ারণ্যে গন্ডার। ছবি: পিটিআই
জীববৈচিত্রে ভরপুর মেদিনীপুর। মানে অবিভক্ত মেদিনীপুর। বাঘ এক সময়ে ছিল মেদিনীপুরের জঙ্গলে। তা স্থান নাম এবং লোককথায় অস্তিত্ব রেখে গিয়েছে। তার পর তো বাংলার এক রাজকীয় বাঘ নিজেই হাজির হয়েছিল অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে। কিন্তু গন্ডার আগে ছিল এর প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু ভারতীয় গন্ডার নিয়ে গবেষণাকারীরা দাবি করছেন, মেদিনীপুরের স্যাঁতস্যাঁতে নদীর চরে, লম্বা ঘাসের বনে ঘুরে বেড়াত একশৃঙ্গী গন্ডার।
মেদিনীপুরে গন্ডারের পায়ের ছাপ খোঁজার আগে একবার ভারতের বন্দি এবং খোলা পরিবেশে গন্ডারের খবর নেওয়া যেতে পারে। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শায়ের ম্যানেজারের কাছে একটি স্ত্রী জাভার গন্ডার প্রায় দশ বছর রাখা ছিল। ১৮৮৭ সালে সেটি কলকাতার আলিপুর চিড়িখানায় রাখা হয়। সেটি প্রায় দশ বছর চিড়িখানায় ছিল। ১৮৯২ সালে মারা যায় গন্ডারটি। কিন্তু নবাবের ম্যানেজার কী ভাবে এই স্ত্রী গন্ডারটি পেয়েছিলেন, সেটা জানা যায়নি। কেনই বা তিনি ওই গন্ডারটি তাঁর কাছে রেখেছিলেন সে বিষয়েও কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটা পরিষ্কার, ওই সময় কলকাতার কাছেই সুন্দরবনে গন্ডারের দেখা মিলত। আবার ১৮৮২ সালে একটি লোম যুক্ত গন্ডার (রাইনেসেরাস ল্যাসিয়েটিস) এবং একটি সুমাত্রীয় গন্ডার (রাইনেসেরাস সুমাতট্রেনসিস) আলিপুর চিড়িয়াখানায় ছিল। প্রথমটি ১৮৯২ সালে এবং পরেরটি ১৯৮৭ সালে মারা যায় ।
এশিয়ায় মোটামুটি তিন ধরনের গন্ডার দেখা যায়। ভারতীয় গন্ডার, জাভান গন্ডার আর সুমাত্রীয় গন্ডার। এর মধ্যে ভারতীয় এবং জাভান গন্ডার একশৃঙ্গী। সুমাত্রার গন্ডারের দু’টি শৃঙ্গ। আজ থেকে দেড়শো থেকে দু’শো বছর আগে অবিভক্ত মেদিনীপুরের উত্তরে রূপনারায়ণ নদ, হুগলি নদী অববাহিকা জুড়ে এবং কলকাতার উপকণ্ঠে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় সুন্দরবনের কাছে ভারতীয় গন্ডার দেখা যেত। এমনকি ‘জাভান’ গন্ডারও দেখা যেত। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, লম্বা ঘাস, নানান প্রজাতির গাছ এবং জল আছে এমন জায়গা জুড়ে গন্ডার থাকতে ভালবাসে। কলকাতার থেকে কিছু দূরে গঙ্গা থেকে শুরু করে মেদিনীপুরের উত্তরের রূপনারায়ণ নদ, মহানদীর অববাহিকা এবং বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড় অবধি সেই পরিবেশ ছিল। ফলে গন্ডারও ছিল। ‘দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াজ ইউনিকর্নস’ বইয়ে এই তথ্য মিলেছে। বইয়ের ত্রয়ী লেখক, দিব্যভানু সিংহ, অশোককুমার দাস এবং শিবানী বসু।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ শতকের শুরুতে প্রায় পাঁচ লক্ষ গন্ডার বিশ্বে ছিল। এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯০০০টি। এই পরিসংখ্যানও কতটা ঠিক সে বিযয়ে সন্দেহ আছে। মোটামুটি এশীয় গন্ডার সন্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তাতে সুমাত্রার গন্ডার সর্বোচ্চ ২০০টি, জাভান গন্ডার সর্বোচ্চ ৪৫টি এবং ভারতীয় গন্ডার ৩৬০০টি মতো আছে। এদের বিস্তৃতি হিমালয়ের পাদদেশ থেকে তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চিন, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, জাভা-সুমাত্রার দ্বীপগুলিতে।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়ে গন্ডার নিধনের শুরু হয়। ভারতেও প্রায় একই সময় মেদিনীপুরের উত্তরে রূপনারায়ণ নদ, হুগলি নদী দিক থেকে শুরু করে সুন্দরবন, হিমালয়ের পাদদেশ, বিহারের গঙ্গা অববাহিকায়, উত্তরপ্রদেশ, অসম-সহ সর্বত্র গন্ডার মারা শুরু হয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ব্যাপক বোমা বর্ষণে, ভিয়েতনামের যুদ্ধে চিন ও ভিয়েতনামে ব্যাপক গন্ডার মারা যায়। যুদ্ধের কারণে গন্ডারের বাসস্থান, খাবার ও পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। শুধু ভিয়েতনামেই জাভার গন্ডারের বিস্তীর্ণ বনভূমি নষ্ট হয়ে যায়। গন্ডার তার বেঁচে থাকার পরিবেশ হারানোয় শয়ে-শয়ে গন্ডার মারা পড়ে। তাদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, ফলে গন্ডারের বংশবৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও একসময় ব্যাপক গন্ডার মারা হয়। মেদিনীপুরের উত্তর দিক এবং সুন্দরবনের গঙ্গার বিস্তীর্ণ অববাহিকায়, হিমালয়ের পাদদেশে তিস্তা-তোর্সা-জলঢাকা এইসব নদীর আববাহিকায় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি গন্ডার নির্মূল করে গড়ে ওঠে মানুষের বসতি। হারিয়ে যায় বাসস্থান, ধীরে-ধীরে বিলুপ্তি ঘটে।
বর্তমানে এক শৃঙ্গের ভারতীয় গন্ডার ও বিলুপ্তির মুখে। জাভান গন্ডার আর সুমাত্রার গন্ডার ভারতের বনাঞ্চলে আর নেই বলে মনে করা হচ্ছে। গন্ডারের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়ায়, অসমের কাজিরাঙায় এবং উত্তরপ্রদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে করা হয়েছে। আরও নতুন কিছু জায়গা বাড়ানো হচ্ছে। শুধু এশিয়ায় নয় আফ্রিকায় সাদা এবং কালো গন্ডারও প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে কালো গন্ডার সর্বসাকুল্যে ৫০০০টি মতো বর্তমান। কেনিয়ায় একটি সাদা গন্ডার ছিল। নাম সুদান। ২০১৮ সালে সেটি মারা যায়। গন্ডারটিকে রক্ষা করার জন্য ২৪ ঘণ্টাই বনরক্ষীরা পাহারা দিতেন।
এক সময় চিনে, ভিয়েতনামে গন্ডারের শিং মানুষের জ্বর, লিভারের অসুখ এবং ক্যানসারের মতো রোগে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হত। লোকে মনে করতেন, গন্ডারের শিংয়ের এমন রোগহর গুণ রয়েছে। শুধু তাই নয় সৌভাগ্য, যৌবন ধরে রাখার জন্য এবং নানান ওষুধ তৈরির কাজেও বেশ কিছু দেশ গন্ডারের শিং ব্যাবহার করত। চিন, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিমের দেশগুলিতে গন্ডারের শিংয়ের ব্যাপক চাহিদা। আমাদের দেশের সোনার যা দাম প্রায় তার সমান বা তার বেশি গন্ডারের শিংয়ের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম। গন্ডারের শিংয়ের জন্য সারা বিশ্বে গন্ডার শিকার এত বেশি। ভারতে ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণ আইন চালু হয়েছে এবং এর পর থেকেই গন্ডার শিকার জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে। ভারতে বন্যপ্রাণ আইনে গন্ডার সংরক্ষিত তালিকায় ১ নম্বর স্থানে অবস্থান করছে। আশার কথা, পশ্চিমবঙ্গের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গন্ডারের নতুন আবাসে অল্প হলেও এক শৃঙ্গের ভারতীয় গন্ডার ধীরে-ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং তাদের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ানো হচ্ছে। চোরাকারবারিরা সবসময় ওঁৎ পেতে রয়েছে গন্ডারের মূল্যবান শিংয়ের জন্য।
ভারতে মোট একশৃঙ্গ গন্ডারের শতকরা নব্বই শতাংশই অসমের কাজিরাঙা অভয়ারণ্য এবং অন্যান্য কয়েকটি জায়গায় বর্তমানে আছে। বাকি ১০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে এবং উত্তরপ্রদেশে আছে। আশার কথা পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া ২১৬.৫১ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্র জুড়ে অভয়ারণ্যে বর্তমানে প্রায় ১৬০টির মতো একশৃঙ্গী গন্ডার আছে। এ ছাড়া গরুমারা, চাপরামারি অভয়ারণ্যে কিছু গন্ডার ছাড়া হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, অল্প হলেও পশ্চিমবঙ্গে গন্ডারের সংখ্যা ধীরে-ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি হচ্ছে তাদের বিচরণের ক্ষেত্র। তারা ফিরে পাচ্ছে স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা। তবে কলকাতার কাছাকাছি অবিভক্ত মেদিনীপুরের উত্তরে এবং সুন্দরবনের গঙ্গার অববাহিকায় যে একশৃঙ্গ গন্ডার এবং জাভার গন্ডারের বাসভূমি ছিল তা আর ফেরানো যাবে না।
লেখক অবরসরপ্রাপ্ত বনাধিকারিক