পাঠক নেই, তাই পাঠাগার নেই?

পাড়ার পাঁচ জন মিলে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, মেয়েদের গল্পের আসর, শিশুদের ক্লাব, বৃদ্ধদের আড্ডা, সবের জন্য গন্তব্য ছিল লাইব্রেরি। তারই সঙ্গে চলত বই পড়া।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৯ ০০:১৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

শেষ কবে পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়েছেন? মনে না-পড়া আশ্চর্য নয়। এক সময়ে লাইব্রেরি কেবল কাজের জায়গা ছিল না, ছিল সামাজিক মেলামেশার জায়গা। পাড়ার পাঁচ জন মিলে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, মেয়েদের গল্পের আসর, শিশুদের ক্লাব, বৃদ্ধদের আড্ডা, সবের জন্য গন্তব্য ছিল লাইব্রেরি। তারই সঙ্গে চলত বই পড়া।

Advertisement

লাইব্রেরি আজও আছে। গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি লাইব্রেরি। তার প্রায় অর্ধেক (২,৪৮০) চলে সরকারি তত্ত্বাবধানে, রাজ্য সরকারের জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার পরিষেবা দফতরের অধীনে। কিন্তু ‘আছে’ বললে হয়তো ভুল হয়। বলা চলে, কোনও মতে টিকে আছে। গ্রন্থাগারিক এবং কর্মীর অভাবে বহু লাইব্রেরি ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ, গ্রন্থাগারিকের মোট ৫,৬০০ পদের মধ্যে ফাঁকা প্রায় চার হাজার। গত দশ বছর কোনও নিয়োগ হয়নি। বন্ধ থাকা লাইব্রেরির সংখ্যা অন্তত সাড়ে ছ’শো। আবার কোথাও কোথাও এক এক জন গ্রন্থাগারিক দু’তিনটি লাইব্রেরির কাজ সামলাচ্ছেন। কখনও কেবল গ্রুপ ডি কর্মী লাইব্রেরি খোলা রাখছেন। অনেক লাইব্রেরি খোলা থাকছে সপ্তাহে দুই বা তিন দিন। যেমন, যাদবপুরে বাপুজিনগর সাধারণ পাঠাগারে বিজ্ঞপ্তি টাঙানো আছে, সপ্তাহে দু’দিন খোলা থাকবে।

কলকাতা-ঘেঁষা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় অন্তত সাতাশটি লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে যেমন বেহালা (নবারুণ সঙ্ঘ, বেহালা সাহিত্য পরিষদ) বা বাঁশদ্রোণীর (জয়শ্রী পাঠাগার) লাইব্রেরি রয়েছে, তেমনই রয়েছে ডায়মন্ড হারবারের লাইব্রেরি (দুর্গানগর সবুজ সঙ্ঘ)। আবার সুভাষগ্রামে হরনাথ বীণাপাণি পাঠাগার এবং জয়নগর বান্ধব পাঠাগার, এই দু’টিই চালাচ্ছেন এক জন গ্রুপ ডি কর্মী। বারুইপুরেও এক জন গ্রুপ ডি কর্মী দু’টি পাঠাগার চালাচ্ছেন। যাতায়াতের খরচ নিজের পকেট থেকে। সমস্ত জেলায় প্রায় একই ছবি।

Advertisement

তবে কি সরকার ধরেই নিয়েছে যে পাঠক নেই, তাই লাইব্রেরি চালিয়ে লাভ নেই? তা-ও বলা যায় না। কারণ গত ফেব্রুয়ারিতে জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার পরিষেবা বিভাগ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয় যে, দুই মাসের মধ্যে দেড় কোটি সদস্য তৈরি করার জন্য বিশেষ অভিযান চালাতে হবে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের (বন্ধ-সহ) ২,৪৮০টি সাধারণ গ্রন্থাগারে যদি দেড় কোটি সদস্য গ্রহণ করা হয়, তা হলে প্রত্যেকটি গ্রন্থাগারকে ছ’হাজারেরও বেশি সদস্য জোগাড় করতে হবে, রীতিমতো ফর্মে সই করিয়ে। যে সব এলাকার লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে রয়েছে, সেখানে কী করে সদস্য তৈরি করা সম্ভব,

সে এক মস্ত প্রশ্ন। আর একটা প্রশ্ন, যে লাইব্রেরি সপ্তাহে পাঁচ দিন বন্ধ থাকে, তার সদস্য হতে লোকে আগ্রহী হবে কেন? বিশেষত যেখানে ‘সতর্কতামূলক জমা পাঁচশো টাকা, বিলম্ব জরিমানা মূল্য দুই টাকা প্রতি দিন।’

সদস্যসংখ্যা সত্যিই বাড়ল কি না, তা নিয়ে হয়তো সরকারি আধিকারিকদের তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা কেমন, তা-ও লক্ষ করা দরকার। এক জন কর্মী দু’তিনটি পাঠাগার চালাবেন, পুরনো সদস্যদের পরিষেবা দেবেন, লাইব্রেরির দৈনন্দিন জরুরি কাজগুলি করবেন, প্রতি সপ্তাহে সদস্যদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করবেন (বছরে বাহান্ন হাজার টাকা বরাদ্দ) এবং সেই সঙ্গে নতুন সদস্য তৈরি করবেন! এই কাজগুলিকে সরকার যদি সত্যিই মূল্য দিত, তা হলে তার এমন ব্যবস্থা হত না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বাস্তব পরিস্থিতির ফারাকটা ক্রমশ বেআব্রু হয়ে পড়ছে।

পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। দু’শো পঁয়ত্রিশ বছর আগে, এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলায় গ্রন্থাগারের সূচনা। ১৮৩৬ সালে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হয়। তার জন্য দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ বাঙালিদের অবদান বড় কম নয়। উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপেও এমন লাইব্রেরি ছিল খুব কম। উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলার জেলায় জেলায় সাধারণ গ্রন্থাগার তৈরি শুরু হয়। বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তিকে সংবর্ধনা জানাতে জেলার মানুষ বেছে নিতেন জেলার লাইব্রেরিকে। সাধারণ গ্রন্থাগার নির্মাণ ছিল বস্তুত জাতীয় আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

কেবল কলকাতাতেই এমন অন্তত সতেরোটি পাড়ার লাইব্রেরি রয়েছে, যেগুলো একশো ত্রিশ বছর পেরিয়েছে। শশীপদ ইনস্টিটিউট (১৮৬৭) নিমতলার ইউনাইটেড রিডিং রুমস (১৮৭২), মুদিয়ালি লাইব্রেরি (১৮৭৬), তালতলা পাবলিক লাইব্রেরি (১৮৮২), বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি (১৮৮৩)— এগুলো কি কলকাতার ঐতিহ্য নয়? এগুলোর কোনওটিরই অবস্থা ভাল নয়। অথচ দুর্লভ বই ও পত্রপত্রিকার সম্পদে সেগুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কোনও কোনওটি উঠে যাওয়ার মুখে। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পুরনো বইপত্র, নেহাত কেজিদরে।

পাড়ার লাইব্রেরি হারিয়ে গেলে শুধু যে কিছু বই আমরা হারাব, তা নয়। হারিয়ে যাবে আমাদের ইতিহাসের অনেকটা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement