—ফাইল চিত্র।
গত বৎসর ছিল চল্লিশ লক্ষ। এ বৎসর ভোট ফুরাইতেই আবার ধাক্কা— আরও এক লক্ষ। অসমকে অবৈধ বিদেশি-মুক্ত করিবার লক্ষ্যে নাগরিক পঞ্জির যে খসড়া, তাহা এই ভাবেই ধাপে ধাপে বাড়িতেছে। সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির নির্দেশেও সেই অতি-উদ্যমী খসড়া তৈরির প্রকল্পে কোনও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আসে নাই। কতখানি অপটু ভাবে কাজ চলিতেছে, তাহার প্রমাণ একেবারে হাতেনাতে। উনিশশো আশির দশকে যে অসম আন্দোলনের ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং আজিকার বিদেশি-গণনার ভাবনাটির সূচনাবিন্দু তৈরি হয়, সেই আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ও প্রথম মহিলা শহিদ বৈজয়ন্তী দেবীর নিজের পরিবারের মানুষও আজ বিদেশি বলিয়া গণ্য হইয়াছেন— সদ্য-প্রকাশিত অতিরিক্ত তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে তাঁহার ভ্রাতৃজায়া ও দুই ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম। ইহা একটি বিক্ষিপ্ত উদাহরণ মাত্র। কিন্তু এই একটি উদাহরণই বলিয়া দেয় যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিবারে যদি এমন ঘটনা ঘটে, তবে সাধারণ মানুষ সে রাজ্যে কী অবস্থায় আছেন। রাষ্ট্রের এই নিষ্পেষণনীতির চাপে অর্থসম্বলহীন দরিদ্র পরিবারগুলির চরম দুর্দশা, মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীরও ভোগান্তি ও অসহায়তা অপরিসীম। ভারতীয় বাস্তবের সহিত এতটুকু পরিচিত মাত্রেই বুঝিবেন, নিজেদের পারিবারিক শিকড় প্রমাণের জন্য পরিচিতিসংবলিত সরকারি কাগজ খুঁজিয়া দাখিল করা এই দেশে খুব কমসংখ্যক লোকের পক্ষেই সম্ভব। অসমবাসী গোর্খাদের মতো যে সব গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ়, তাহারা দৃঢ় ভাবে ইহার মোকাবিলার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এমন দৃঢ়বদ্ধ সামাজিক গোষ্ঠীর বাহিরে— সুতরাং সম্পূর্ণ দিশাহারা অসহায়তায় নিমজ্জিত।
প্রসঙ্গত, এনআরসি-র মূল ভাবনাটি যে খুব আপত্তিকর, তাহা নহে। অসমবাসীর ক্ষোভের সঙ্গত কারণ আছে। বহু দশক ধরিয়া অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়ায় এই রাজ্য নাজেহাল, কোনও না কোনও ভাবে সেই প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি জরুরি। কিন্তু যে পদ্ধতিতে এই কাজ হইতেছে, সেই পদ্ধতিটি অত্যন্ত অবাঞ্ছিত। এক দিকে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, অন্য দিকে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের মধ্য দিয়া হিন্দু ও মুসলিমদের যে বিভেদরেখা অঙ্কিত হইতেছে, তাহা বিষম বিপজ্জনক। ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি এই ভাবে বিদ্বেষ ছড়াইবার পথ হিসাবে এনআরসি ব্যবহৃত হইতেছে, এবং তাহাতে ঘৃতাহুতি দিতেছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের সহিত যৌথ উদ্যোগে বিষয়টির পুনর্বিবেচনা এবং পদ্ধতির পরিবর্তন সাধন। অথচ, সেই উচিত-কাজটির কোনও ইঙ্গিত নাই। পরিবর্তে, এখন, সম্ভবত কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ উৎসাহদানে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও এনআরসি চালু করিবার ‘হুমকি’ দিতেছেন বিজেপি নেতারা। বুঝিতে অসুবিধা নাই, এনআরসি-র মাধ্যমে অনুপ্রবেশ সঙ্কটের মোকাবিলার অপেক্ষা এনআরসি-র অস্ত্রে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরিই আপাতত বিজেপি দলটির লক্ষ্য। দেশের নানা প্রান্তে মানবাধিকার কর্মী ও সচেতন নাগরিকরা আগেই সরব হইয়াছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে শতাধিক গবেষক-অধ্যাপক এই মর্মে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে চিঠি পাঠাইয়াছেন। ‘সিটিজ়েনস ফর অসম’ গত এক বৎসর ধরিয়া ডি-ভোটার ও খসড়া-ছুটদের সঙ্কট এবং ফরেনার ট্রাইবুনালগুলির অন্যায় কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইয়া আসিতেছে। সম্প্রতি আবারও নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে খসড়া তৈরির দাবি শোনা গিয়াছে তাঁহাদের কাছ হইতে— ঠিক যে নির্দেশ দিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। বাস্তবিক, প্রধান বিচারপতি রীতিমতো ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন এনআরসি-কে। অথচ বিচারবিভাগ বা নাগরিক সমাজ, কাহারও কড়া বক্তব্যে রাজনীতির কর্তাদের বিন্দুমাত্র হেলদোল নাই।