এর পরেও বলতে হবে, সংখ্যালঘুরা ভাল আছেন?

যখন অসমে নাগরিক পঞ্জীকরণে ৪০ লক্ষ মানুষকে বাদের তালিকায় রেখে সারা ভারতে সে পদ্ধতি প্রয়োগের কথা বলা হয়, তখন কি মনে হয় সত্যিই মুসলিম মানুষ ভাল আছেন? লিখছেন সুমন সেনগুপ্ত এই সমস্ত বিষয়েও বেশির ভাগ নাগরিক চুপ থাকেন। কেউ উল্টে প্রশ্ন করেন না যে মুসলিমেরা কি সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় নন, না কি তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? তা হলে কি বেশির ভাগ ভারতের নাগরিকও এমনটাই মনে করেন? 

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০৩:০১
Share:

তা না হলে আজকের এই সামাজিক মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল সময়ে মানুষকে ভুল বোঝানোটা অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে না? ভুল তথ্য যে ভাবে ছড়ানো হচ্ছে তাতে কি পাশের বাড়ির অন্য ধর্মের মানুষটির সম্বন্ধে আরও বেশি করে জানা বা আরও পরিচিত হওয়া জরুরি নয়?

Advertisement

এই সমস্ত বিষয়েও বেশির ভাগ নাগরিক চুপ থাকেন। কেউ উল্টে প্রশ্ন করেন না যে মুসলিমেরা কি সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় নন, না কি তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? তা হলে কি বেশির ভাগ ভারতের নাগরিকও এমনটাই মনে করেন?

যখন অসমের নাগরিক পঞ্জীকরণের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ৪০ লক্ষ মানুষকে বাদের তালিকায় রেখে দিয়ে সারা ভারতে সেই পদ্ধতি প্রয়োগের কথা বলা হয় এবং সেটা বলার সময়ে ‘উইপোকা’র তুলনা টানা হয়, তখন কি মনে হয় সত্যিই মুসলিম মানুষ জন ভাল আছেন? গত কয়েক বছরে যে ভাবে মুসলিম এবং দলিতদের পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে এবং তার পরে যারা এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাঁদেরকেই মালা দিয়ে বরণ করেছেন। এর পরেও বলতে হবে সংখ্যালঘু মানুষেরা ভাল আছেন? এমন একটা রাতও কি তাঁরা কাটিয়েছেন যে রাতে তাঁরা সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন? আসলে যারা পেহেলু খান, আখলাকদের হত্যা করছে তাদেরকেই যখন জাতীয় নায়কের মর্যাদা দেওয়া হয় তখন কি ভারতের সংবিধান স্বীকৃত সহনাগরিকেরা ভাল থাকতে পারেন? যখন গুজরাট দাঙ্গায় মূল অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি পায়, যখন বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সাধ্বী প্রজ্ঞার মতো ব্যক্তিকে সংসদে পাঠানোর জন্য টিকিট দেওয়া হয়, তখন এটা মুসলিমদের ভয় পাওয়ানো ছাড়া আর কী? তখন এটা কি বলে দিতে হয় যে এই সব পদক্ষেপ আসলে আমাদেরই সহনাগরিককে মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে থাকারই নিদান দেওয়া! এমন ভারতের স্বপ্ন কি আমরা দেখতে পারি না যেখানে প্রতিটি নাগরিকের ধর্মচর্চা করার এবং না করার অধিকারটাও পাশাপাশি এক সঙ্গে থাকবে? এই ভারতের স্বপ্ন কি আমরা দেখতে পারি না যেখানে শুধু মাত্র ধর্মের কারণে, নামের কারণে ‘শবনম’দের তাঁদের বন্ধুরা দূরে ঠেলে দেবে না?

Advertisement

যখন ঝাড়খণ্ডে তাবরেজ আনসারিকে গণপিটুনির শিকার হতে হয়, যখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোজ খবর আসে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানোর জন্য সংখ্যালঘু মানুষদের মারা হচ্ছে, তখন এর বিরুদ্ধে একজোট হওয়াটা জরুরি। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কলকাতায় এসে বলে গিয়েছেন ‘জয় শ্রীরাম’ বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। তাঁকেও আক্রমণ করা হয়েছে। বিরুদ্ধ মত শোনার মতো শিক্ষা, ধৈর্য, অভিজ্ঞান— আমরা কি কিছুরই পরোয়া করব না?

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে তা হলে কি বলতে হবে আমরা খুব সুখের সময়ে বাস করছি? যদিও উদারপন্থীদের একটা অংশ এর বিরোধিতা করেছেন। তথাপি এটা বলার কি সময় হয়নি যে আমাদের সকলের এই মুহূর্তে দেশের যে সনাতন ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য চলে আসছে, সেই অনুশীলনে আবার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে? বিশেষ করে যখন অবিরত মিথ্যে আর বিদ্বেষের প্রচারে যখন দলিত, সংখ্যালঘু মানুষের পিঠ প্রায় দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে!

এখন প্রয়োজন বহু গণতান্ত্রিক বলিষ্ঠ কণ্ঠের, হাজার লেখনীর। দরকার তাঁদের, যাঁরা মনে করিয়ে দিতে পারতেন সেই অতীত ঐতিহ্যের কথা, যে ঐতিহ্য আমাদের শিখিয়েছিল প্রতিটি মানুষ তাঁর নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে এই দেশে থাকবেন, অন্যকে আঘাত না করেই থাকবেন। যে ঐতিহ্য আমাদের শিখিয়েছিল, পাশের বাড়ির অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নাম ধর্মনিরপেক্ষতা।

লালন ও চৈতন্যদেবের বাংলায় কী দরকার একটি নির্দিষ্ট স্লোগানের? পরের প্রজন্মকে সুন্দর একটি পরিবেশ দেওয়ার লক্ষ্যে, ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে যাবতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি ও ভালবাসার প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। প্রয়োজন মানুষের কাছে পৌঁছে মানুষের জন্যই জোট বাঁধার।

লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement