১৯৯৩ সনে আসছি ভাই। না, সে রকম কোনও অত্যাচার হয় নাই। জমি নিয়া সমস্যা হইত মাঝে মাঝে। এইখানে মেয়ের বিয়া হইল, তখন আমিও আইলাম।’’— বক্তা গেদে নিকটবর্তী এক গ্রামের মানুষ এবং হিন্দু।
এই পর্যন্ত বলার পরেই কয়েক জন যুবক এসে তাঁকে চুপ করালেন এবং আমার সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করলেন। কে, কোথা থেকে আগমন— এ সব জানার পর তাঁরা বাংলাদেশে হিন্দুদের অবস্থা ও জামাতের কার্যকলাপ বিষয়ে অনেক আলোচনা করলেন। তবে, সবকিছুর মধ্যে একটা প্রধান জানানোর বিষয় তাঁদের ছিল যে, তাঁদের বাবা-কাকারা সবাই ৭১ এর আগে ঝামেলা আঁচ করে চলে এসেছিলেন। কিন্তু এ দেশে এসেও তারা ‘মুক্তি’দের সাহায্য করেছেন। হ্যাঁ, এনআরসি বা ‘National Register of Citizens’ কি, তা তাঁদের ভালই জানা আছে। কিন্তু তাঁদের ভয় কী, ও সব এখানে কিছু হবে না। সতর্ক ভাবে কিন্তু হাসি মুখে কথা বলা ওই যুবকেরা সীমান্তবর্তী এই জেলার অনেক মানুষের প্রতিনিধি যাঁরা অনেকটা আমাদের অলক্ষেই এক ধরনের শঙ্কা বুকে লালন করছেন। নিজের গবেষণার কাজে নদিয়ার গ্রামগঞ্জে ঘুরতে গিয়ে দেখেছি, অনেক গ্রামে লিফলেট বিলি হচ্ছে, যেখানে এনআরসি হলে কী হতে পারে, কী কী ডকুমেন্ট লাগতে পারে, কোথায় এনআরসি নিয়ে সভা ডাকা হচ্ছে— এই সব লেখা থাকছে। ফেসবুকে জেলার বহু মানুষ এনআরসি নিয়ে বিষোদ্গার করে চলেছেন। কোথাও কোনও বিশেষ সংবাদপত্রের এমন খবর কোট করা হচ্ছে যে, এই রাজ্যে গোপনে এনআরসি আসলে চালু হয়েই গিয়েছে। আশঙ্কা ও গুজবের এই আবহে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল লাভের কড়ি কুড়োতে মাঠেও নেমে পড়েছে।
কিন্তু আমার উপলব্ধি এই যে, বেশিরভাগ মানুষ যাঁরা সন্ত্রস্ত, তাঁরা এনআরসি-র পদ্ধতিগত বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্যক সচেতন নন। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম জনগণনার সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের একটি হিসাব রাখার জন্য এই নাগরিক পঞ্জি তৈরি করা হয়। ২৪ মার্চ, ১৯৭১ সালের মধ্যরাত্রির পূর্বে যাঁরা ভারতে এসেছেন এবং যাঁদের এই সংক্রান্ত বিভিন্ন নাগরিক প্রমাণপত্রগুলির মধ্যে যে কোনও একটি রয়েছে অথবা যাঁদের পূর্বপুরুষের উল্লিখিত তারিখটির আগের কোনও প্রমাণপত্র রয়েছে, তাঁরা নাগরিক হিসাবে এনআরসি-তে স্বীকৃতি পাবেন। অসমে একটি ত্রিস্তরীয় প্রক্রিয়ায় মূল্যায়নের পর আনুমানিক যে ৪০ লক্ষ মানুষ আপাতত এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা প্রাথমিক ভাবে ১২০ দিন সময় পাবেন। যার মধ্যে তাঁরা বিদেশিদের জন্য বিশেষ আদালত বা ট্রাইবুনালে আবেদন করতে পারবেন এবং পরবর্তীতে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও যেতে পারবেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশ মন্ত্রক এই বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছে যে, এনআরসি সংক্রান্ত প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভাবে একটি আইনগত বিষয়। যেহেতু এটি ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত অসম একর্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তা সত্ত্বেও বহু আদিবাসী মানুষ, পুরনো স্থানীয় অধিবাসি, সরকারি কর্মচারী এমনকী, সৈনিকদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার অভিযোগ উঠেছে, যা সম্পূৰ্ণ ভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রসঙ্গত, এনআরসি-র সঙ্গে যুক্ত প্রক্রিয়াটি জটিলতা ও বহরে প্রায় উপমাহীন। যে কোনও রাজ্যেই প্রক্রিয়াটি চালু হলে এই ধরণের ভ্রান্তির আশঙ্কা যথেষ্ট। পাশাপাশি, কোনও ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত বিদেশি বলেই শনাক্ত হলে তাঁর বিষয়ে রাষ্ট্র কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। মধ্যবর্তী পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিকে ‘কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ বলা বাড়াবাড়ি নিশ্চয়ই। তবে সেগুলিতে যে স্বাস্থ্য প্রভৃতি জরুরি পরিষেবাগুলি কিছুটা অপ্রতুল, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। নদিয়ায় বসবাসকারী বহু হিন্দু, বিশেষ করে, মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্তেরা অনেকেই তাই এনআরসি নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন। চর এলাকার মানুষেরা বিশেষ ভাবে শঙ্কিত। কারণ তাঁদের কথা অনুযায়ী, বিএসএফ বা অন্য সরকারি প্রতিনিধিরা তাঁদের বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে।
এই পরিস্থিতিতে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের উদ্বেগ স্বাভাবিক। অসমের উদাহরণ বলছে যে, সেখানে মিয়াঁ— যা কতক তাচ্ছিল্য করেই তাঁদের ডাকা হয়, তাঁরা হয়তো বা একটু বেশি কড়া পরীক্ষার মুখে পড়েছেন। এমনকী, যাঁদের নাম ঢুকে গিয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রেও অসমের ছাত্র সংগঠনগুলির তরফ থেকে প্রচুর আপত্তি তোলা হয়েছে। এবং চারটি ট্রাইবুনালের ডাটা বলছে যে, সেখানে মুসলিমদের বেশি যেতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকার এখনও অবধি জোর দিয়ে বলেছে যে, মুসলিমদের সঙ্গে কোনও বিশেষ আচরণ এ ক্ষেত্রে করা হচ্ছে না। তবে এই দাবির সঙ্গে সিটিজেনশিপ বিল সংশোধনের চেষ্টা, যেখানে নন-মুসলিম শরণার্থীদের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, সেটি সঙ্গতিপূর্ণ কি না— তা ভাবার বিষয়। তবে এনআরসি মানেই তা মুসলিম-বিরোধী এবং বিজেপি-র চক্রান্ত— এই ধারণার পালে বাতাস তোলার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অল্পবিস্তর রয়েছেই। অসমে ২০১০ সালে এনআরসি পাইলট প্রোজেক্ট কংগ্রেস আমলেই শুরু হয়, তা ভুললে চলবে না। এটাও মনে রাখতে হবে মুসলিমদের বাংলাদেশে জোর করে পাঠানো হবে— এটা অনেকটাই অলীক ধারণা। যেহেতু, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কোনও repatriation চুক্তি নেই এবং তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশ সফরে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বিষয়টির ধার দিয়েও যাননি।
সীমান্তের গ্রামগঞ্জের ছাপোষা মানুষ এতে কতটা আশ্বস্ত হবেন জানা নেই। সম্প্রতি মণিপুরের ক্যাবিনেট এনআরসি বিষয়ে সিলমোহর দিয়েছে। বাংলায় আসন্ন লোকসভা ভোটের হাওয়া এখনই গরম। রাজায় রাজায় যুদ্ধে উলুখাগড়ার জমিজিরেতে টান পড়বে কি না— সময়ই একমাত্র বলতে পারবে।
লেখক কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান