ছবি: সংগৃহীত
গোল গোল দানার ভাত। মুসুর ডাল, উচ্ছে ভাজা, পটল ভাজা। আর কুমড়ো-পুঁইডাঁটা- আলুর সঙ্গে কুঁচো চিংড়ি দিয়ে তরকারি, যা মুখে দিলে জীবন ধন্য হয়ে যায়। ফেরিনৌকা, ভটভটি ভ্যান আর কাদাপথে পায়ে হেঁটে যাত্রার শেষ যে বানভাসি গ্রামে, তার কমিউনিটি কিচেনে এমন আহার! বাইরে আকাশ ঘোলাটে, ভিতরে রান্নার প্রশংসা শুনে কবিতা মুন্ডা, মল্লিকা সর্দারের মুখে হাসির রোদ। ঘরের চাল উড়ে গিয়েছে, ভেড়ির মাছ ভেসে গিয়েছে, কাজ হারিয়েছে বর, তা বলে কি হাসি ফুরিয়েছে? একটু পরেই রান্নাঘর ধুয়ে ওরা মিটিংয়ে বসবে। ঠিক করবে, আর কত দিন চালাতে হবে ইস্কুল ঘরের গণরসুই।
কোন জাদুতে মারণ-ঝঞ্ঝায় সর্বস্বান্ত হয়ে ফের স্বাদে-স্নেহে জীবনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে মানুষ? সন্দেশখালির ন্যাজাট গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই গ্রামের উদ্যোক্তা সুশান্ত মুন্ডা বললেন, “ঝড়ের পর ভাবলাম, একটু খাবারের জন্য গ্রামবাসী কোথায় ঘুরবে? কার কাছে হাত পাতবে? তার চাইতে গ্রামেই রান্না করব। পঞ্চায়েত দু’দিনের চাল দিল। তা-ই দিয়ে শুরু।” এখন ২২০ জন খাচ্ছেন দুটো গণরসুইতে। আমপানের পর মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছিলেন যে ডাক্তারবাবু, তিনি সে বার দেখা গ্রামবাসীদের এ বার দেখে খুশি। “বিএমআই-টা তখন মাপা হয়নি, নইলে মনে হয় মাসখানেকে একটু উন্নতিই দেখতাম।”
প্রভাব যেমন পুষ্টিতে, তেমন প্রত্যয়েও। গ্রামের সভায় ঠিক হল, যদি দানের টাকা না মেলে, গ্রামবাসীরাই চালাবে সমবেত রান্না। সুবিধে অনেক। যে যার ঘরে রেঁধে খেতে হলে মাথাপিছু ত্রিশ টাকা পড়েই। গণরসুইতে দৈনিক দশ টাকা চাঁদা। দেশ-বিদেশ থেকে আমপান-দুর্গতদের জন্য টাকা জমা পড়ছে স্বেচ্ছাসেবীদের তহবিলে। তেমন এক তহবিল থেকে ডাল-সয়াবিন মিলছে। যাঁদের ভেড়ি রয়েছে, তাঁরা রোজ গণরসুইতে দিচ্ছেন খানিকটা চিংড়ি বা চুনোমাছ। চাঁদার টাকায় আনাজ, বাড়তি একটু মাছ কেনা হচ্ছে। সবার রান্না একসঙ্গে হলে জ্বালানি, তেল-মশলার খরচ বাঁচে। শ্রমশক্তিও বাঁচে। কারণ পালা করে চার-পাঁচ জন মেয়ে রান্না করছে সবার জন্য। ঘর মেরামত, রাস্তা সারাইয়ের জন্য বাড়তি হাত পাওয়া যাচ্ছে।
এ তো নতুন কথা কিছু নয়। সেই রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘আত্মশক্তির উদ্বোধন’। কোনও কোনও গ্রাম কী করে সেই জাদুমন্ত্র খুঁজে পায়, অন্যরা পায় না? তিন-চার কিলোমিটার দূরত্বে আর এক গ্রামেও গণরসুই চলছে। সেখানে রোজ ভাত, ডাল, আলু-সয়াবিন। পাতে একটু শাক, চিংড়ি বা চুনোমাছ কিছুই নেই। অথচ এখানেও জীবিকা ‘ফিশারি’, ওখানেও। এ পাড়ায় মাছ জোটে না কেন? সয়াবিন-চিবোনো মেয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, যার ভেড়ি সে মাছ বেচে দিচ্ছে। সবার জন্য দেবে কেন? “ইউনিটি তৈরি করতে একটু সময় লাগে”, বললেন সুশান্ত। এ পাড়ায় তাঁদের আরও সময় দিতে হবে।
কে পারল গণরসুই খুলতে, আর কে পারল না, তার উপর কেবল পুষ্টিই নির্ভর করে না। হাসনাবাদে পাশাপাশি, একই মাপের দুটো গ্রামে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি সংগঠন, ‘কোয়রান্টিন স্টুডেন্টস ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’। একটা গ্রামে চলছে গণরসুই, অন্য গ্রামে চাল-আলুর প্যাকেট বিতরণ। ক’দিন পর ঠিক হল, দুই গ্রামের পড়ুয়াদেরই ল্যাম্প দেওয়া হবে। কত ল্যাম্প চাই? গণরসুইয়ের গ্রাম থেকে বলা হল ৪০টা। প্যাকেট-বিলোনো গ্রাম চাইল ২৩০টা।
ছাত্র নেটওয়ার্কের অন্যতম উদ্যোক্তা মন্মথ রায় এতে আশ্চর্য হননি। “যখনই মাথাপিছু কিছু দেওয়া হয়, প্রত্যেকটি মানুষ তার পাশের জনের চাইতে বেশি চায়। যেন পাশের বাড়ির মানুষটাই তার সব চাইতে বড় শত্রু।” সুশান্ত বললেন, “যে চেয়েও পায় না, তার রাগ গিয়ে পড়ে যে পেয়েছে তার উপর।” প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার রাগ। রেষারেষি ঠেকানোর মহৌষধ — গণরসুই।
মস্ত কড়ায় আনাজ পড়ে, আর ফোড়ন-সুগন্ধি হাওয়ায় প্রশ্ন ভাসে— বিতরণে দুর্নীতিকে দুষব, না কি বিতরণের মডেলটাকেই? যাঁদের নাম তালিকায় উঠেছে, যাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন, তাঁরাও তো কই নেতাদের হয়ে দুটো কথা বলছেন না। সে কি কেবল স্বার্থপর বলে, না কি বিতরণের ন্যায্যতা নিয়ে তাঁদেরও সন্দেহ আছে? থাকা আশ্চর্য নয়, কারণ কে ত্রিপল পাবে, কে বাড়ি ভাঙার ক্ষতিপূরণ, তার পূর্ণ ছবি গ্রামবাসীর কাছে নেই। অথচ তার সহজ উপায় ছিল, গ্রামসভা। পঞ্চায়েতের ক্ষমতা রয়েছে ইমার্জেন্সি গ্রামসভা ডাকার। সরকার যদি নিয়ম করত, কে কী পাবে তার তালিকা গ্রামসভা ডেকে ঠিক করতে হবে, তা হলে দুর্নীতির গোড়ায় ঘা পড়ত। অন্তত ত্রাণপ্রাপকদের তালিকা চূড়ান্ত করার আগে বিডিও তা গ্রামের মানুষের কাছে প্রকাশ করতে বাধ্য নন কেন? এ যেন চোরকে সিঁধ কাটতে ডেকে নিয়ে এসে লোক দেখাতে পুলিশ ডাকা।
সবাইকে নিয়ে সভা করে তালিকা হয় না, সবাইকে নিয়ে খোলা হয় না গণরসুই। লক্ষণীয়, এ রাজ্যে লকডাউন আর আমপানের তীব্র অন্নকষ্টের সামনে দাঁড়িয়েও প্রায় কোনও পঞ্চায়েত বা পুরসভা গণরসুই খোলেনি, নিজের উদ্যোগে খুলেছেন অল্প দু’চার জন নেতা। প্রায় সব কিচেন খুলেছেন সন্ন্যাসী আর স্বেচ্ছাসেবীরা। চাল বিলি, ত্রাণ বিলির অস্বচ্ছতা কি শুধু ‘টাকা খাওয়ার’ লাইসেন্স? হয়তো কেবল সেটাই কারণ নয়। তৃণমূল সরকার খাদ্যসাথীর কার্ড, কন্যাশ্রীর তালিকা, দুর্যোগের পর ফসল ক্ষতিপূরণ বা সাইকেল বিলিতে সে ভাবে আমরা-ওরা করেনি, যা ত্রাণে দেখা যাচ্ছে। অথচ পঞ্চায়েত এবং সমবায়, যে দু’টি প্রতিষ্ঠান দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধনে সর্বাধিক সুযোগ করে দেয়, সেগুলিকে ত্রাণে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে দেয়নি। তাদের কাজ বার বার ব্যাহত হয়েেছ গত নয় বছরে। নির্বাচন হচ্ছে না, টাকা ‘নামানো’ হচ্ছে না, নির্বাচিত সদস্যদের উপর বসছে দলের লোক, নইলে প্রশাসনের বড়-মেজো আধিকারিকরা। কেন?
আসলে যখন পাঁচ জনে মিলে সবার জন্য একটা কাজ করে, তখন কে কোন দলের (এমনকি কে কোন ধর্ম বা জাতের) তা তুচ্ছ হয়ে যেতে চায়। সহমত, সহযোগ না হলে চলে না। গ্রাম পঞ্চায়েত, সমবায় থেকে গণরসুই, যখন তা সজীব, সচল, তখন প্রায়ই এমনটা দেখা যায়। কিন্তু সেটা বড় নেতাদের কাছে মস্ত ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতি যেন হাল্লার রাজার যুদ্ধযাত্রা, সতত সংঘাত-উন্মুখ সেনাই রাজনৈতিক বিত্ত। যা সামাজিক বিত্তের ঠিক বিপরীত। পরস্পর আস্থা, নির্ভরতাকে বিশেষজ্ঞরা বলেন ‘সামাজিক বিত্ত’ (সোশ্যাল ক্যাপিটাল)। তা সবাইকে সমৃদ্ধ করে। আমি সবার জন্য করলে সবাই আমার জন্য করবে— এই বিশ্বাস থেকে কেউ চিংড়ি, কেউ কুমড়ো এনে দেন গণরসুইয়ে। কিছু দিন পর দেখা যায়, সবার অপুষ্টি কমেছে।
সুন্দরবনের মন্দ কপাল, সেখানে দলাদলির সঙ্গে রয়েছে এনজিও-দের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গ্রামে যে একটু চৌকস তাকেই ‘লোকাল কো-অর্ডিনেটর’ করে টানা হয়। আত্মশক্তির বাঁধ কেটে ফান্ডিংয়ের ঘোলাজল ঢোকে গ্রামে গ্রামে। একই গণরসুই দেখিয়ে একাধিক সংস্থার থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে আমপান-বিধ্বস্ত এলাকাতেও।
সরকারি ও অসরকারি দুর্নীতির যে বহর সুন্দরবনের মানুষ দেখেন, দুনিয়ায় তার জুড়ি কম। তবু তিক্ত বঞ্চনা থেকে সহযোগিতার রসদ আহরণ করে চলেছেন তাঁরা। যেন নিমের মধু।