প্রতীকী চিত্র।
যে কোনও গ্রামে চলে যান। মেঠো পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলে দেখবেন, কোথাও কোনও কর্মযজ্ঞ নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, গত ছ’মাসে এক কোদাল মাটিও পড়েনি, বরং বোমা পড়েছে। কেউ কেউ এ কথাও জানাবেন যে, সারা রাত আতঙ্কে ছিল গ্রাম।
উন্নয়ন স্তব্ধ। অস্থিরতা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। তা সে কোচবিহারই হোক বা গোটা উত্তরবঙ্গ। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সদ্য উপনির্বাচনের ফল প্রকাশ হয়েছে। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের ঝুলিতে গিয়েছে তিনটি আসনই। যা অনেকটাই অক্সিজেন জুগিয়েছে রাজ্যের শাসকদলকে। তা হলে কি কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে বা উন্নয়ন? না, এখনও তেমন কোনও আভাস নেই। কারণ, ফল ঘোষণার রাতে বহু জায়গাতেই আবারও সেই বোমার আওয়াজই শুনতে পেয়েছেন মানুষ। প্রশ্নটা এখান থেকেই শুরু হয় যে, দল-সরকার-প্রশাসন, যা মানুষের উন্নয়নের জন্যই, সেখানে কেন এমন অস্থিরতা তৈরি করে বার বার উন্নয়ন বন্ধ করে দেওয়া হবে?
এ কথা কম-বেশি সকলেই মানেন যে, অস্থিরতা উন্নয়নের পক্ষে বড় বাধা। গত ছ’মাস ধরে যে অস্থিরতা বেড়েছে, সে কথাও কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু কেন এই অস্থির পরিস্থিতি? কেউ কি খুব পরিকল্পিত ভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে সেখান থেকে ফয়দা নেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন? মানে, এর পিছনে কি বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে? ২০১১ সালে তৃণমূল বামেদের সরিয়ে রাজ্যের মসনদে বসে। প্রায় গোটা রাজ্যেই তৃণমূলের প্রভাব তখন বাড়তে শুরু করে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের হঠিয়ে তিনটি স্তরেই নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে তৃণমূল। সেই সময় থেকে উন্নয়নের কিছু নজির সামনে আসতে শুরু করে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রকল্পের সুবিধে মানুষ পেতে শুরু করেন। একশো দিনের কাজও গ্রামে গ্রামে নজরে পড়ে। শুধু যে কাজই হয়েছে, তা অবশ্য নয়। সঙ্গে দুর্নীতিও ছিল অনেক জায়গায়। এটা এখন আর কোনও লুকনো বিষয় নয়। অল্প সময়ের মধ্যে শাসকদলের নেতাদের ফুলেফেঁপে ওঠা, কাটমানি ফেরত দেওয়া, এমন বহু ছবিই ভেসে উঠেছে। তার পরও যতটুকু হয়েছে, তা নিয়েই কিছুটা সন্তুষ্ট ছিলেন জনগণ।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ১৮টি আসনে জয়লাভ করে বিজেপি। উত্তরবঙ্গে আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে জয়ী হয় বিজেপি। একটি আসন কংগ্রেস পায়। তৃণমূল উত্তরবঙ্গ থেকে খালি হাতে ফেরে। তার পর থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। পঞ্চায়েত প্রধানেরা দলে দলে বিজেপিতে যোগ দেন। অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলেও যান। দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস। আর খোলা থাকলেও সেখানে পঞ্চায়েত প্রধানেরা না থাকায় কোনও কাজের সুযোগ ছিল না। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের একটি শংসাপত্র পেতেও হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছে বাসিন্দাদের। প্রশাসনও যেন হাত গুটিয়ে বসেছিল। পরে অনেকে আবার শাসকদলে ফিরে গেলেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। সেই সময় থেকেই গ্রামের পর গ্রাম রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হতে শুরু করে। বোমা-গুলি যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। হারিয়ে যায় উন্নয়ন। সেই যে শুরু হয়েছে, থামেনি এখনও। প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রামে গ্রামে ছুটতে শুরু করেছে, কিন্তু কাজ আদৌও হবে কি? না কি দুই দলের টানাটানিতে সেই একই অবস্থায় পড়ে থাকবে গ্রাম আর সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিতই হতে থাকবেন?
আভাস সেই রকমই। দুই দলের নেতা-কর্মীরাই কর্তৃত্ব দখলের লড়াইয়ে নেমেছেন। কেউই পিছু হঠতে রাজি নয়। এখানেই সরকার ও প্রশাসনের আরও দায়িত্ব নেওয়া দরকার। কারণ, যে উত্তরবঙ্গ থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কাজের জন্য ভিন্ রাজ্যে চলে গিয়েছেন, এখনও অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন অজানার পথে, সেখানে সরকারি প্রকল্পের সুবিধে পাবেন না মানুষ, তা হয় না। সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা উচিত। যদি কোথাও কোনও দুর্নীতি ধরা পড়ে বা অভিযোগ ওঠে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এবং কাজ বন্ধ থাকা কখনওই কাম্য নয়।
প্রশাসনের আরও কঠিন হাতে পদক্ষেপ করা উচিত। তা না হলে কাউকেই সাধারণ মানুষ ছেড়ে কথা বলবেন না। তা সে রাজ্যের শাসকদলই হোক বা কেন্দ্রের। লোকসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গে উড়েছিল গেরুয়া আবির, আর বিধানসভা উপনির্বাচনে সেই উত্তরের একটি আসনেই উড়ল সবুজ আবির। উত্তরবঙ্গ চাইছে, এ বার গ্রাম, শহর, মফস্সলে উড়ুক উন্নয়নের আবির!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)