রাহুল গাঁধী।
গত দফায় ছিল ৪৪। বাড়িয়া, ২০১৯ সালে তাহা দাঁড়াইয়াছে ৫২। কংগ্রেসের অন্দরমহলে কাঁপুনি ধরিবে, তাহাতে সংশয় কী? কিন্তু, এই সমূহ পরাজয়ের যে প্রতিক্রিয়া আকবর রোড ও জনপথ হইতে পাওয়া যাইতেছে, তাহা নির্বাচনী ভরাডুবির অপেক্ষাও মারাত্মক। নরেন্দ্র মোদীর বিজয়রথ থামাইতে রাহুল গাঁধী সফল হন নাই, তাহা প্রশ্নাতীত। কিন্তু, তাঁহার বদলে অন্য কেহ কংগ্রেসের সভাপতি হইলেই দলের চেহারা বদলাইয়া যাইবে, এই ভাবনায় অতিসরলীকরণ আছে। দলের অন্যান্য নেতারা সেই দায়িত্ব লইতে প্রস্তুতও নহেন— তাঁহারা রাহুল গাঁধীর বাড়ির সম্মুখে ধর্নায় বসিয়া হাসির খোরাক হইতেছেন। অনুমান করা চলে, তাহার কারণ অন্তত দ্বিমুখী— এক, কেহ ডুবন্ত জাহাজের হাল ধরিয়া রাজনৈতিক আত্মহত্যায় সম্মত নহেন; দুই, দলের অভ্যন্তরে যুযুধান গোষ্ঠীপতিরা একে অন্যকে জায়গা ছাড়িতে এমনই নারাজ যে তাঁহারা শীর্ষস্থলে রাহুলকেই বসাইয়া রাখিতে চাহেন। ব্যাধিটি নূতন নহে। নেহরু-গাঁধী পরিবারের উপর অতিনির্ভরশীলতার প্রকোপ ভারত আগেও দেখিয়াছে। সমস্যা হইল, রাহুলের নেতৃত্ব যে যথেষ্ট হইতেছে না, তাহাও স্পষ্ট। এ-ক্ষণে কি তবে চাপানউতোরই অনিবার্য? চেনা খোপের বাহিরে ভাবিবার সাহস থাকিলে একটি বিকল্প পথ ভাবিয়া লওয়া সম্ভব। সভাপতির পদে কোনও এক ব্যক্তির পরিবর্তে একাধিক নেতা লইয়া একটি গোষ্ঠী তৈরি করা যায়। হাইকম্যান্ডের ধারণার পরিবর্তে একটি প্রেসিডিয়ম ব্যবস্থা। দলের পরিচালনভার ন্যস্ত হইবে সেই গোষ্ঠীর উপর। সেই গোষ্ঠীতে সনিয়া, রাহুল বা প্রিয়ঙ্কা থাকিবেন কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন। একক নেতৃত্বের যে সমস্যায় কংগ্রেস ভুগিতেছে, তাহা হইতে নিস্তারের অন্য পথ আকবর রোডের জানা আছে কি?
দলের অভ্যন্তরে নির্বাচনী পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া হওয়া বাঞ্ছনীয়। ২০১৪ সালে কংগ্রেসে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না বলিয়াই ২০১৯-এর ভরাডুবি কি না, সেই জল্পনা চলিতেই পারে। কিন্তু, প্রতিক্রিয়ার চরিত্রটি কী হইবে, তাহাও ভাবা প্রয়োজন। কংগ্রেসে যাহা চলিতেছে, তাহার মধ্যে দিশাহীনতা স্পষ্ট। সভাপতি পদ হইতে রাহুলের পদত্যাগ সংক্রান্ত যদি কুনাট্যের একটি দিক হয়, তবে অন্যটি হইল, আগামী এক মাস কোনও গণমাধ্যমে কংগ্রেসের কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকিতে দিবার সিদ্ধান্ত। এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের আপাত কারণ, তাঁহাদের অবিবেচক বক্তব্যে রাহুল গাঁধীর সিদ্ধান্ত লইতে সমস্যা হইতে পারে! এ-হেন যুক্তি লইয়া কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নাই। কংগ্রেস কয়েকটি কথা স্মরণে রাখিতে পারে। নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপির তৈরি করিয়া দেওয়া আজেন্ডা অনুসারে খেলা তাহাদের পক্ষে আত্মঘাতী হইবে। দলে পরিবারতন্ত্র আছে কি না, থাকিলে তাহা কতখানি ক্ষতিকর— প্রতিটি কথাই গুরুত্ব দিয়া বিচার করা বিধেয়, কিন্তু বিজেপি বলিতেছে বলিয়া নহে। লালুপ্রসাদ যাদব মনে করাইয়া দিয়াছেন, আজ নেহরু-গাঁধী পরিবারের বাহিরে কেহ দলের শীর্ষপদে বসিলে বিজেপি সম্ভবত তাঁহাকে ‘জনপথের হাতের পুতুল’ বলিয়া প্রচার করিতে আরম্ভ করিবে। কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেসের বরং ভাবা প্রয়োজন, ঠিক কোথায় ভুল হইয়া গেল। ‘ন্যায়’ প্রকল্পটিকে সাধারণ মানুষের নিকট যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য করিয়া তোলা গেল না কেন? জন-আন্দোলন তৈরি করিতে দল গত দশ বৎসর যাবৎ ক্রমাগত ব্যর্থ হইতেছে কেন? বিভিন্ন রাজ্যের দলীয় নেতাদের স্বার্থ সর্বভারতীয় স্বার্থের সহিত সমানুবর্তী হইতেছে না কেন? যে উগ্র জাতীয়তাবাদ এই নির্বাচনের ভবিতব্য স্থির করিয়াছে, তাহার আয়ু অনন্ত নহে। কিন্তু, একটি প্রতিস্পর্ধী ভাষ্য তৈরি করিতে গেলে যে পরিশ্রম এবং জনসংযোগ প্রয়োজন, কংগ্রেস কি তাহাতে প্রস্তুত? এখনও যে ১২ কোটি মানুষ কংগ্রেসকে ভোট দিয়াছেন, তাঁহাদের ধরিয়া রাখিতে দল কী করিবে? সভাপতি বদলাইলেই জাদুবলে এই প্রশ্নগুলির উত্তর মিলিবে না।