ক্ষুব্ধ: রাস্তায় রাস্তায় জমায়েত ও প্রতিবাদ, অমৃতসর, ১৪ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই। ইনসেটে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: কৃষিক্ষেত্রে তিনটি সংস্কার নিয়ে পঞ্জাবে চাষিদের মধ্যে মস্ত আন্দোলন শুরু হয়েছে। নয়া আইন কি গ্রহণযোগ্য নয়?
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথমে আমি একটি বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে চাই। সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিক আমার ছবির তলায় কৃষি-সংস্কার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর বক্তব্য প্রকাশ করেছে। কৌশিকবাবু তাঁর এই বক্তব্যটি ‘টুইট’ করেছিলেন। আমার টুইটে মতামত জানানোর অভ্যাস নেই, এবং এ বিষয়ে কোনও মতামতই আমি জানাইনি। এ ভাবে তথ্যবিকৃতি আমার খুবই খারাপ লেগেছে।
দ্বিতীয়ত, আমি প্রশ্ন তুলব এই সংস্কারের ‘সময়’ নিয়ে। এখন অতিমারির জন্য অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে, খাদ্য-সহ নানা অত্যাবশ্যক পণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটছে। নীতিতে কোনও বড় সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এটা নয়।
প্র: কৃষিতে সংস্কার কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
উ: অবশ্যই আছে। যে সময়ে বর্তমান কৃষিনীতি তৈরি হয়েছিল, সেটা ছিল খাদ্যাভাবের সময়। দেশে যত লোক, সকলকে খাওয়ানোর সাধ্য ছিল না। কৃষি উৎপাদনের যে পরিকাঠামো তখন তৈরি হয়েছিল, সেটা সেই সময়ের প্রয়োজন মেনে তৈরি হয়েছিল। তার পর বহু দশক ধরে সেই পরিকাঠামোতেই আরও বেশি করে বিনিয়োগ করেছিল রাষ্ট্র, যেমন বিনা পয়সায় বিদ্যুতের জোগান, বা কম দামে ইউরিয়া। সেই জন্য হয়তো চাষিরা ভেবেছিলেন যে, এমনই বরাবর চলবে, এবং সেই ভেবে বহুবিধ বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা। যেমন বহু টাকা দিয়ে গভীর নলকূপ তৈরি। কিন্তু ক্রমে পরিস্থিতি বদলেছে। এখন ভারতে খাদ্যশস্য-সহ নানা ফসল উদ্বৃত্ত। এখন কৃষি উৎপাদনের পরিকাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। চলতি ব্যবস্থাটার বড় বড় গলদ রয়েছে।
পঞ্জাবের চাষের দিকেই দেখা যাক। সেখানকার অধিকাংশ খাদ্যশস্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কিনে নেয়, যে দাম বিশ্বের বাজারের চাইতে দেড়গুণ বেশি। দ্বিতীয়ত, বিপুল পরিমাণ শস্য রেশন ব্যবস্থায় বণ্টনের পরেও জমে থেকে নষ্ট হচ্ছে। কোনও সরকারই তা সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে পারছে না। তৃতীয়ত, সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন চাষি। চতুর্থত, জলের ভান্ডারের ক্ষয় হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে যত জল লাগে ধান উৎপাদন করতে, পঞ্জাবে লাগে তার তিনগুণ। তার কারণ পঞ্জাবে যখন ধান হয় তখন শুকনো গরম থাকে। এর ফলে পঞ্জাবে জলের অভাব দিন দিন বাড়ছে। এই সব কারণে এই ব্যবস্থা যে চির দিন চলতে পারে না, তা চাষিরাও উপলব্ধি করতে পারছেন। তাই তাঁরা উদ্বিগ্ন। কেন্দ্রীয় সরকার যতই বলছে, সহায়ক মূল্য রদ করা হবে না, চাষিরা ততই সহায়ক মূল্যের দাবি তুলছেন। কারণ তাঁরা বুঝতে পারছেন, এত দিন যে ভাবে তাঁরা বাজারের দামের চাইতে অনেকটা বেশি সরকারের থেকে পেয়ে চলেছেন, তা বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব নয়। যে শিকে আগে ছিঁড়েছিল, তা চির কাল ছেঁড়া থাকবে না। অর্থনীতির দৃষ্টিতে কৃষি উৎপাদন-বিপণনের যে মডেল, তার মেয়াদ বাড়ানোর যুক্তি নেই।
প্র: সহায়ক মূল্য উঠে যাবে, চাষিদের এই উদ্বেগ কি অহেতুক?
উ: একেবারেই নয়। যাঁরা সকল খরিদ্দারের কাছে ফসলের বাজার খুলতে চান, তাঁরাই ভারতে শস্যের দামকে বিশ্বের শস্য-বাজারের দামের কাছাকাছি আনার পক্ষে সওয়াল করছেন। সুতরাং, একটা হলে যে অন্যটাও হবে, এক বার দরজা খুললে যে সব সুরক্ষাই একে একে উধাও হবে, সেটা ভাবাটা অহেতুক নয়। হয়তো সরকার যদি কোনও ভাবে চাষিদের এক ধরনের ‘বার্ষিক রোজগার নিশ্চয়তা’ দিতে পারে, অর্থাৎ এখন তাঁদের যা গড় বার্ষিক রোজগার, সরকার এখন বেশ কয়েক বছর তা নিশ্চিত করতে পারে, তা হলে চাষিরা এতটা উদ্বিগ্ন না-ও হতে পারেন।
তবে আমার মনে হয়, চাষি সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে এই নতুন নীতিতে সায় দেবেন, এমন সম্ভাবনা কম। তাঁরা সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না। সরকার তাঁদের বলছে, চাষি যাকে চান তাকেই ফসল বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু চাষি ভয় পাচ্ছেন যে, বড় কর্পোরেটরা এক বার প্রবেশ করলে স্থানীয় বাজার উঠে যাবে। আড়তদার দেখবে, বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা তার নেই। সারা বিশ্বেই অসম প্রতিযোগিতায় ছোট ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হয়েছেন। শেষ অবধি বাজারে কতগুলো বৃহৎ কোম্পানি টিকে থাকবে, এবং তারা ফসলের কত দাম দেবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষি। আমি যত দূর নয়া কৃষি আইনগুলো দেখেছি, তাতে বৃহৎ কোম্পানিগুলি ফসলের বাজারে প্রবেশ করতে তাদের কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। কোনও বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা একাধিপত্য বা ‘মোনোপলি’ কায়েম করতে চাইলে সরকার তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু করবে, সেই আস্থা চাষিদের নেই।
প্র: নয়া শিক্ষানীতি নিয়ে আপত্তির কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রতাপভানু মেহতা লিখেছেন, ‘‘ইট ইজ় নট দ্য টেক্সট বাট দ্য কনটেক্সট।’’ নীতিতে যা লেখা আছে, সমস্যা তা নিয়ে নয়, আপত্তি প্রেক্ষাপট নিয়ে।
উ: কৃষি নীতিতেও ঠিক তা-ই। পুরো খেলাটা লিখিত নীতি নিয়ে নয়, তার পিছনের গল্পটা নিয়ে। কর্পোরেট ‘মোনোপলি’ সরকার প্রতিরোধ করতে অনিচ্ছুক, বা অপারগ, এই বোধটা ছড়িয়ে যাওয়ার কারণ কৃষি আইনের কোনও ধারার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা সরকারের কথায় আস্থাহীনতার ফল। এই জিএসটি নিয়ে যেটা হল, সেটার কথাই ধরা যাক। এক দিন কেন্দ্রীয় সরকার জানাল যে, জিএসটি আইনের ভিত্তিতে যে বরাদ্দ টাকা দেওয়ার কথা সেটা দিতে পারবে না। তাতে সরকারের কথার দাম যে কতটা, তা নিয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। তা ছাড়া সরকার বার বার বলছে টাকা নেই, তাই ভয় হতেই পারে যে, হয়তো গরিবকে ভর্তুকি দেওয়ার টাকাতেও টানাটানি পড়বে।
তাই কৃষি আইন নিয়ে আন্দোলনের আমরা দুটো দিক দেখতে পাচ্ছি। এক দিকে, কৃষির বর্তমান পরিকাঠামো যে দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, সে বোধটা পঞ্জাবের চাষিদের মধ্যে কাজ করছে। অতএব সরকার মুখে যা-ই বলুক, বর্তমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চাইবে না, বা পারবে না, এই উদ্বেগ তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অন্য দিকে, চাষির স্বার্থ সুরক্ষিত করেও রাষ্ট্র কৃষি পরিকাঠামোয় পরিবর্তন আনতে পারে, সেই সম্ভাবনায় চাষিরা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
প্র: ইউরোপ আমেরিকা ভর্তুকি দেয় চাষিদের, আমরাই বা দেব না কেন?
উ: ভর্তুকি দেব কি দেব না, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। অতীতে ইউরোপে এই ভর্তুকি আমাদের সহায়ক মূল্যের মতো ছিল, চাষিদের রাজনৈতিক শক্তির কারণে তাতে হাত লাগানো যেত না। তার ফলে মাখনের পাহাড় জমেছিল ইউরোপে। এখন ইউরোপে চাষিদের সোজাসুজি টাকা দেওয়া হয়, খানিকটা আমাদের পিএম কিসানের মতো। আমাদেরও সে দিকে যাওয়াটা বোধ হয় সমীচীন।
প্র: চাষির রোজগার দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছে কেন্দ্র। কৃষিনীতির ভিত্তি কি এমন কোনও লক্ষ্য হওয়া উচিত?
উ: ২০২২ সালের মধ্যে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করা যাবে, এটা আমার কাছে কোনও দিনই খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। এবং আরও বেশি চাল আর গম উৎপাদন বাড়িয়ে সেটা বোধ হয় সম্ভবও নয়— কে খাবে অত চাল-গম? সুতরাং আমাদের চাষিদের ফল-সব্জি, বিশেষত যে ফল-সব্জির বিশ্বের বাজারে দর ভাল, এবং যেগুলো পরিবেশ-বান্ধব, সেগুলো বেশি করে উৎপাদনের দিকে এগোতে হবে। এগোচ্ছে না যে তা নয়, একটু একটু পরিবর্তন আসছে, তবে সেটাকে আরও অনেক উঁচুস্তরে নিয়ে যেতে নানাবিধ বিনিয়োগ দরকার। সেখানে প্রাইভেট কর্পোরেট ক্ষেত্রের ভূমিকা আছে বিলক্ষণ। কিন্তু আমাদের একটা নতুন নিয়ন্ত্রণের পরিকাঠামো (রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক) দরকার, যেখানে চাষিদের স্বার্থটাকে আগলে রেখে কর্পোরেটদের ঢুকতে দেওয়া যায়।
সাক্ষাৎকার: স্বাতী ভট্টাচার্য